• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ৭ জ্বিলকদ ১৪৪৫
যাত্রাবাড়ী ধলপুর

উন্মুক্ত স্থানে গোসল করতে বাধ্য হচ্ছেন বস্তির নারীরা


তাহনিয়া ইয়াসমিন
প্রকাশিত: মে ২৭, ২০২২, ১০:০২ পিএম

বাংলাদেশ উন্নয়শীল দেশ হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করছে বিশ্বের দরবারে। কিন্তু এ দেশের মোট জনসংখ্যার একটা বড় অংশ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। আধুনিকতা বা ডিজিটাল জীবন তাদের কাছে কল্পনার অতীত। যাত্রাবাড়ীর ধলপুর সিটিপল্লী তেমনই একটি জায়গা। যেখানে আধুনিক জীবনব্যবস্থা তো দূরের কথা, নেই পর্যপ্ত থাকা বা গোসলের সুব্যবস্থা। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ট্রাকে ময়লা তোলা, ভাঙারির দোকানি, নিরাপত্তা প্রহরী ও রিকশাচালক।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোকগণনা ২০১৪ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা সদর ও অন্যান্য অঞ্চলে বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩৮। সেসব বস্তিতে ২২ লাখ মানুষ বাস করছেন, যার অর্ধেকই নারী।

বিবিএস ও ইউনিসেফের ‘চাইল্ড ওয়েলবিয়িং সার্ভে ২০১৬’ অনুসারে সিটি করপোরেশন এলাকায় বসবাসরত ব্যক্তিদের এক-তৃতীয়াংশই বস্তিতে বাস করেন। সেই হিসাবে ঢাকায় বস্তিতে থাকেন আনুমানিক ৬১ লাখ মানুষ। উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০২০ সালের তথ্য অনুসারে, ঢাকার লোকসংখ্যা ১ কোটি ৮৪ লাখ।

নিরাপদ গোসলখানার সংকট

অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রোগশোকে দিন যাপন করছেন বস্তির মানুষ। নেই কোনো স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা। কোথাও ৪৮ পরিবারের জন্য একটি গোসলখানা। আবার কোথাও ৭০ পরিবারের জন্য একটি। গোসলখানার চারপাশ আটকানো থাকলেও, নেই ওপরের ছাদ। ফলে নিরাপত্তহীনতায় দিন কাটছে বস্তির নারীদের।

এ বিষয়ে কথা হয় ১৯ বছরের সুরমার সঙ্গে। তিনি জানান, খোলা গোসলখানায় গোসল করে বস্তির সব নারী। বস্তির কোনো কোনো গোসলখানায় পোশাক পাল্টানোর জন্য ছাদঘেরা জায়গা থাকলেও, বেশির ভাগে তা নেই। ফলে ভেজা কাপড়ের ওপর তোয়ালে জড়িয়ে বাসায় চলে যেতে হয় তাদের। এভাবে খোলা জায়গায় গোসল করাটা খুব অস্বস্তিকর, ভালো করে গোসল করাও সম্ভব হয় না। তা ছাড়া নারী-পুরুষ একসঙ্গে গোসল করাতে লজ্জার বিষয়টি তো আছেই। কিন্তু উপায় কী!

সিটিপল্লী ১৪ নম্বর আউপল, ধনপুর সিটিপল্লীর ইউনিট সেক্রেটারি জুলহাস জানান, ৫০ থেকে ৬০ হাজার মানুষ থাকে এই বস্তিতে, যাদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছ ১৫০-১৮০টি গোসলখানা। ৩২ বছর আগে ২৩০ ঘরে পুনর্বাসন হলেও, তারপর থেকে তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি।

মাসিকের সময় ভয়াবহ সময় কাটে নারীদের

খোলা জায়গায় নারী-পুরুষের একসঙ্গে গোসলের কারণে মাসিকের সময় আরও বেশি সংকটে পড়েন বস্তির নারীরা। প্রতিনিয়ত বিড়ম্বনা আর শঙ্কায় থাকতে হচ্ছে তাদের। অল্পসংখ্যক নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করলেও বস্তির বেশিরই অস্বাস্থ্যকর নোংরা কাপড় ব্যবহার করেন।

মাসিকের সময়টাতে কীভাবে সবকিছু সামলান, জানতে চাইলে অস্বস্তিতে পড়ে যান কিশোরী আয়শা। বয়স ১৭ হলেও কোলে একটা শিশুসন্তান আছে। জানতে চাইলে বলেন, এ সন্তান তারই। একদিকে বয়স কম, অন্যদিকে বিয়ে-সংসার-সন্তান। মলিন মুখটার দিকে তাকানো যায় না।

আয়শা জানান, মাসিকের সময় অন্য মেয়েদের মতো তিনিও কাপড় ব্যবহার করেন। দিনের বেলা গোসলখানায় পুরুষদের আনাগোনা বেশি থাকে। গোসলের লম্বা লাইন তো আছেই। এ কারণে মাসিকের সময়টাতে সঠিক সময়ে ময়লা কাপড় পরিষ্কার করতে পারেন না। ঘরের এক কোনায় জমিয়ে রাখেন। সন্ধ্যার পর গোসলখানায় পুরুষেরা কম থাকলেই তখন কাপড় পরিষ্কার করেন। পরে ঘরের কোনায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাপড় শুকান।

শৌচাগারের সংকট চরম পর্যায়ে

জায়গায় জায়গায় এনজিওভিত্তিক কিছু শৌচাগার থাকলেও, নেই পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ। এসব শৌচাগারের সংখ্যাও অনেক কম। প্রতি চার-পাঁচ পরিবারের জন্য একটি টয়লেট বরাদ্দ থাকলেও, পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে নেই কোনো উদ্যোগ। 
নেই রান্নার ভালো পরিবেশ

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিবারের লোকসংখ্যা বাড়লেও, বাড়েনি বাসস্থান। ফলে একই ঘরে গাদাগাদি করে কোনোরকমে দিন পার করতে হচ্ছে বস্তিবাসীর। এখানে প্রতিটি পরিবারের জন্য বরাদ্দ একটি ঘর ও একটি রান্নাঘর। কিন্তু পরিবারের সদস্য সংখ্যাও বৃদ্ধির কারণে রান্নাঘর দখল করেছে মানুষ। ফলে ঘরের কোণে কোনোরকমে মাটির চুলায় রান্না করছেন তারা। তা ছাড়া বর্ষা মৌসুমে বস্তির রূপ নেয় ভয়াবহ। চারদিক ডুবে যায়, ঘরেও প্রবেশ করে বৃষ্টির পানি।

২০১৩ সালে বস্তিতে আগুন লাগার পরে বস্তির লোকজন নিজস্ব অর্থায়নে কিস্তি নিয়ে ঘর করেছেন। খাওয়ার পানির সংকট, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশনসহ নানা অসুবিধা তো আছেই। অন্যদিকে প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ ও করোনা-পরবর্তী সময়ে কর্তৃপক্ষের নজর নেই বলে অভিযোগ তাদের।

তবে এসব বিষয়ে ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বাদল সরকারের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তার কার্যালয় বন্ধ পাওয়া যায়। পরে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “বস্তির উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দলীয় কোনো বিষয় নেই। টয়লেটের অবস্থা আগে আরও খারাপ ছিল। বর্তমানে যেটুক দেখছেন, সেগুলো মোটামুটি বিভিন্ন এনজিও দিয়ে করা হয়েছে। এখন সামনের দিকে তো যতটা উন্নত করা যায়, ততই ভালো। একসময় কিছু ছিল না, এখন তো কিছু আছে। এখন সামনের দিকে আস্তে আস্তে হয়তো উন্নয়ন করবে। আমার পক্ষে যতটা উন্নয়ন করা সম্ভব, ততোটাই করব।’

Link copied!