আনোয়ার পাশা ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তাঁর সাহিত্যকর্মে গভীর দেশাত্মবোধ, মননশীলতা এবং প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর রাইফেল-রোটি-আওরাত উপন্যাসটি রচিত হয় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন এবং মুক্তিযুদ্ধের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণ তিনি দেখে যেতে পারেননি। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী আলবদরদের একটি দল তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায় এবং মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের কাছে হত্যা করে। সেইসব স্মৃতির কথা সংবাদ প্রকাশকে জানান আরেক শহীদ বুদ্ধিজীবী এস. এম. এ. রাশীদুল হাসানের মেয়ে রোকাইয়া হাসিনা নীলি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খাদিজা নিপা।
সংবাদ প্রকাশ : আনোয়ার পাশাকে যেদিন আলবদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায়, সেই ঘটনাটি শুনতে চাই।
রোকাইয়া হাসিনা নীলি : আমার বয়স তখন ১২ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা ছিলেন আমাদের প্রতিবেশী। যেদিন আনোয়ার চাচাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, সেদিন আমরা তাঁর বাসাতেই ছিলাম।
আমরা পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকতাম। যখন আকাশযুদ্ধ শুরু হলো, তখন আমার বাবাকে আনোয়ার চাচা বললেন, রশিদ চলো আমরা রাতে একসঙ্গে থাকি। আসলে চাচা ও বাবা একসঙ্গে সারা সাত থাকতেন, গল্প করতেন, স্বাধীন বাংলা বেতার শুনতেন। তারপর সকালে উঠে বাসায় চলে যেতাম। ১৪ ডিসেম্বর সকালবেলায় আনোয়ার চাচা বললেন রশিদ আজকে চা খেয়ে চলে যেও না। আসো একসঙ্গে নাশতা খাই। তারপর মা-খালা রান্না করলেন। আনোয়ার চাচা খিচুড়ি আর ডিমভাজি খুব পছন্দ করতেন। সবাই একসঙ্গে খুব আনন্দ করে খেয়ে বসে গল্প করছিলাম। একসময় হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দ পেলাম। আনোয়ার চাচার বোনের ছেলে ছিলেন, তিনি দরজা খুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে খাকি পোশাক পরা এবং মুখে কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা ১০—১২টা ছেলে ঘরে ঢুকে গেল। এসেই জানতে চাইল আনোয়ার পাশা কে? আনোয়ার চাচা বাসায় ছিলেন, এসে বললেন আমিই আনোয়ার পাশা। তখন এরা আনোয়ার চাচাকে উদ্দেশ করে বলল, আপনি আমাদের সঙ্গে আসেন। আর অন্যদের বলল, আপনারা দরজা বন্ধ করে দেন। আনোয়ার চাচার বোনের ছেলে দরজা বন্ধ করছিলেন না। তখন বাবা এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলেন, তোমরা কারা, কোথা থেকে এসেছ? এরা বলল, স্যার আমরা ওনাকে একটু নিয়ে যাচ্ছি, কিছুক্ষণ পর এনে দিয়ে যাচ্ছি। আপনারা দরজা বন্ধ করে দেন। আমি তখন বাবার হাত ধরা। আমি দেখেছি একজনের হাতে একটা সাদা কাগজ। পরে জানতে পেরেছি, এটাই বুদ্ধিজীবী হত্যার লিস্ট। সেই কাগজ দেখে বাবা খুব উৎকণ্ঠায় ছিলেন। বাবা কিছুতেই দরজা বন্ধ করতে দিচ্ছিলেন না। আমি বাবার হাতটা শক্ত করে ধরেছিলাম। তখন এদের একজন বাবাকে জিজ্ঞেস করছে, স্যার আপনার নাম কী? বাবা বললেন, রাশিদুল হাসান। তখন তারা বাবাকে বলল, স্যার আপনিও আসেন। বাবা আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেলেন। আমি দেখলাম, বাবার চোখে আর সেই উৎকণ্ঠাটা নেই। কারণ, আমার মনে হয়েছে, উনিও তার বন্ধুর সঙ্গে হয়তো যাচ্ছেন। তখন আমি দৌড়ে গিয়ে মা আর খালাকে বললাম বাবা আর চাচাকে কারা যেন নিয়ে যাচ্ছে। আমরা বারান্দায় গিয়ে দেখলাম এরই মধ্যে তাদের নিচে নামিয়ে নেওয়া হয়ে গেছে। বাবা আর চাচার গায়ে চাদর ছিল, ততক্ষণে তাদের গায়ে থাকা চাদর দিয়ে তাদের চোখ বাঁধা হয়ে যায়। টেনেহিঁচড়ে একটা কাদামাখা মাইক্রোবাসে তোলা হচ্ছে। আমরা তো ওপর থেকে চিৎকার করে কাঁদছিলাম। তখন তারা খুব জোরে বলছিল, কান্না থামাও, গুলি করব এবং ওপরের দিকে গুলি করে নিয়ে চলে গেল।
সংবাদ প্রকাশ : তাদের কাউকে কি চিনতে পেরেছিলেন?
রোকাইয়া হাসিনা নীলি : একজন ছিল, যে কিনা বাংলার ছাত্র, চৌধুরী মঈনুদ্দীন। আমি তাকে চিনতে পারিনি। তবে আব্বার আরেক স্যার শহীদ বুদ্ধিজীবী মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী চিনতে পেরেছিলেন। উনি দরজা খুলে যখন দেখলেন, তখন বললেন মঈনুদ্দীন, তুমি এসেছ? তখন সে বলেছিল, হ্যাঁ, স্যার আমি এসেছি। আপনাকে নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পর আবার দিয়ে যাব। সেই চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের তো বিচার হয়েছে, তবে সেই রায় কার্যকর হয়নি। কারণ এরা দুজনই দেশের বাইরে আছে।
সংবাদ প্রকাশ : আপনার বাবা শিক্ষাবিদ রাশীদুল হাসান নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন, সে বিষয়ে জানতে চাই। লেখাগুলো অপ্রকাশিত কেন?
রোকাইয়া হাসিনা নীলি : আমার বাবা ভোরে ঘুম থেকে ওঠা থেকে একদম বিছানায় যাওয়া পর্যন্ত যা যা করতেন, সব লিখতেন। সেই লেখা ডায়েরি, বিশেষ করে ৭১-এর ডায়েরিটা যেটা খুবই বক্তব্যপূর্ণ। সেটি জাতীয় জাদুঘরে আমরা দিয়েছি। জাদুঘরের মুক্তিযুদ্ধ কর্নারে সেটি রাখা আছে। উনসত্তরের ডায়েরিটা আমার কাছে আছে। আর সত্তরের ডায়েরিটা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রাখা আছে।
আসলে আমার মা যতদিন বেঁচেছিলেন, তিনি চাইতেন লেখাগুলো প্রকাশ করতে। আমি মিডিয়ার সঙ্গে আছি, গান করি। ১৪ ডিসেম্বরে বহু জায়গায় বিভিন্ন সময়ে রেডিও, টেলিভিশন বা বিভিন্ন মঞ্চে বক্তব্য বা সাক্ষাৎকার দিয়েছি। সে সময় যদি কোনো সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা মন্ত্রী থাকলে, তারা আমার কাছে থাকা ডায়েরিটা দেখে অবিভূত হয়েছেন এবং বলেছেন যে, এটা তারা সরকারিভাবে প্রকাশ করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু ব্যাপারটা ওই দিনই শেষ হয়ে যায়। পরে আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। তবে উনসত্তরের ডায়েরিটা আমি ভাবছি, নিজ উদ্যোগে প্রকাশ করব।