সাহিত্য থেকে সমাজের প্রতিটি স্তরের বিনির্মাণে বাঙালি আজও ঋণী রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কাছে। তারা ছিলেন নতুন যুগের বার্তাবাহী। উজ্জীবনের শক্তিধারী। দুজনকেই বলা যায়, রেনেসাঁর পথ প্রদর্শক।
রবীন্দ্রনাথ ব্যাপকভাবে নাড়া দেন জাতে, পাতে, কূলে, গোত্রে বিভক্ত কলকাতা থেকে কুষ্টিয়ার জনপদ। আর নজরুল এককভাবে চেষ্টা করেন বাঙালি মুসলমানকে বের করে আনতে অন্ধকার কুসংস্কারের যুগ থেকে। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের অবদান অন্য যেকোনো সাহিত্যিকের চেয়ে বেশি বলা যায়। তাদের সাহিত্য শুধু টেবিলে বসে পড়ার জন্যই নয়। সমাজ সংস্কারেও কার্যকর প্রভাব রেখেছে এই দুই কীর্তিমানের কর্ম। আজও পৃথিবীর যে প্রান্তে বাঙালি আছেন, তারা অন্য কোনো অনুষ্ঠান পালন করুন বা না করুন রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী ঠিকই পালন করেন। শতবর্ষ পরেও কী বিপুল প্রভাব এই দুই যুগ স্রষ্টার তা অবাক করার।
তবে অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতোন সাহিত্য আঙিনায়ও মতলববাজ কম নেই। তারা চায় মানুষে মানুষে বিভক্তি তৈরি করে হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে। এরা অন্ধকারের প্রতিভূ। অপশক্তির দাস। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে এরা মিথ্যা রটায়। যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। এদের অজ্ঞানতা মাত্রা ছাড়া। মূল বিষয় না জেনে আমাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন। এর কিছু উদাহরণ দেয়া প্রাসঙ্গিক।
প্রায়ই আমরা শুনতে পারি ‘হিন্দু রবীন্দ্রনাথ’ বনাম ‘মুসলমান নজরুল’ এর নামে যা তা মিথ্যার বিস্তার। আদতে রবীন্দ্রনাথ পরিবারিকভাবে হিন্দু বা সনাতন ধর্মের উত্তরসূরি ছিলেন না। তিনি ছিলেন এক ঈশ্বরবাদী ব্রাহ্ম সমাজের ব্যক্তিত্ব। পরিণত বয়সে যে রবীন্দ্রনাথ ধর্মের নামে মানুষে মানুষে ভেদের তৎপরতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। জমিদার হিসেবে তিনি প্রাণান্ত ছিলেন মুসলমান কৃষকদের ভাগ্যের উন্নয়নে।
একইভাবে কাজী নজরুল ইসলাম মুসলিম পরিবারে জন্ম নিলেও তিনি সাহিত্য ও কর্মে লড়াই করেছেন মানবতার পক্ষ নিয়ে। ব্যক্তি জীবনে নজরুল বিবাহ করেছেন হিন্দু নারীকে। আর ইসলামী সংগীত থেকে শ্যামা সংগীত পর্যন্ত তার সকল সৃষ্টি প্রমাণ করে এ জনপদে বিভক্তির দেয়াল উপড়ে ফেলতেই তার ধরায় আগমন।
অনেকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যে ব্যক্তিগত রেষারেষির বিদ্বেষ গপ্পো প্রচার করেন। এটিও মিথ্যাচার। এরও নেই কোনো বাস্তব ভিত্তি। কাজী নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে লিখেছেন,
“বিশ্বকবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধা নয়, পূজা করে এসেছি সকল হৃদয়-মন দিয়ে, যেমন করে ভক্ত তার ইষ্ট দেবতাকে পূজা করে। ছেলেবেলা থেকে তার ছবি সামনে রেখে গন্ধ-ধূপ-ফুল-চন্দন দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা বন্দনা করে। এ নিয়ে কত লোক কত ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছেন।” (‘বড় পিরীতি বালির বাধ’ প্রবন্ধ, আত্মশক্তি পত্রিকা, ১৯২৭)।
একইভাবে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,
“কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু
আয় চলে আয় রে ধূমকেতু,
আধারে বাধ্ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা
জাগিয়ে দেরে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন!”
ব্রিটিশ বিরোধী আপসহীন রাজনৈতিক সংগ্রামের জন্য কাজী নজরুল ইসলাম যখন আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি, তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার রচিত ‘বসন্ত’ নাটকটি তাকে উৎসর্গ করেন উপরের কথাগুলো লিখে। এর বাইরেও দুজনের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত উষ্ণ।








































