শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) একটি আবাসিক হলের ছাত্রীরা গুটিকয়েক দাবি নিয়ে শুরু করেছিলেন আন্দোলন। ছাত্রীদের সেই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে। শুরু থেকে বুধবার (২৬ জানুয়ারি) পর্যন্ত একনজরে তুলে ধরা হলো আন্দোলনের চিত্র—
১৩ জানুয়ারি
রাত সাড়ে ৮টা। বেগম সিরাজুন্নেসা হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ লিজার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেন ছাত্রীরা। প্রাধ্যক্ষ হলে না আসায় ও ‘অসদাচরণ’ করায় রাত ৯টায় হলে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। দুই ঘণ্টা পর রাত ১১টায় ভিসির বাসভবনের প্রধান ফটক ঘেরাও করেন ছাত্রীরা। এরপর রাত ২টায় উপাচার্য বাসভবন থেকে বের হয়ে আসেন ও সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। উপাচার্যের আশ্বাসে রাত আড়াইটায় শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে যান। এ সময় পরদিন শিক্ষার্থীদের অভিযোগগুলো লিখিতভাবে দিতে বলেন উপাচার্য।
১৪ জানুয়ারি
এদিন সকাল ১১টায় শিক্ষার্থীরা তিন দফা দাবি লিখিতভাবে ভিসির কার্যালয়ে জমা দেন। এরপর দুপুর ১২টায় ভিসি শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেন। বেলা ১টায় প্রতিনিধিদল বের হয়ে আসে। উপাচার্য ১ মাস সময় চেয়ে নেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা সময় না দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে প্রভোস্টের রুমে তালা দেন শিক্ষার্থীরা। তিন দফা দাবি মেনে নিতে ১৫ জানুয়ারি (শনিবার) ৭টা পর্যন্ত আলটিমেটাম দেন শিক্ষার্থীরা।
১৫ জানুয়ারি
বিশ্ববিদ্যালয় গোলচত্বরে দাবি আদায়ে বিক্ষোভরত ছাত্রীদের ওপর সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় ছাত্রলীগ হামলা করে বলে দাবি করেন আন্দোলনরত ছাত্রীরা। এ সময় ১০-১২ জনকে বেধড়ক মারধর করে তারা। এরপর সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন। এদিন রাতেও আন্দোলন করেন তারা।
১৬ জানুয়ারি
এদিন বেলা আড়াইটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি ভবনের ৩৩৩ নম্বর কক্ষে ভিসিকে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীরা। খবর পেয়ে বিকেল ৪টায় ক্যাম্পাসে পুলিশ আসে। সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় উপাচার্যকে উদ্ধার করতে শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ, গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পুলিশ। হামলার পর ভিসিকে উদ্ধার করে তার বাসভবনে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে রাত ৯টায় জরুরি সিন্ডিকেট সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেন উপাচার্য। এছাড়া পরদিন সোমবার ১২টার মধ্যে শিক্ষার্থীদেরকে হল ত্যাগের নির্দেশ দেন। এর সঙ্গে তিনি প্রভোস্টের পদত্যাগের কথা জানিয়ে দেন। পুলিশের হামলার পর রাত ১০টা থেকে শিক্ষার্থীরা তিন দফা থেকে উঠে এসে এক দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। তাদের এক দফা দাবি হলো উপাচার্যের পদত্যাগ।
১৭ জানুয়ারি
সকাল ৭টা থেকে ক্যাম্পাসে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। গোলচত্বর ও মূল সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন শুরু করেন তারা। আগের দিনের হামলার ঘটনায় ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ওই দিন পুলিশ ২০০ থেকে ৩০০ অজ্ঞাতনামা শিক্ষার্থীর ওপর মামলা দায়ের করে। দিনগত রাত পৌনে ১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক থেকে সাঁজোয়া যানসহ অতিরিক্ত পুলিশ সরিয়ে নেয় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ।
১৮ জানুয়ারি
এদিন রাত ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে আমরণ অনশনের ঘোষণা দেন। উপাচার্যের পদত্যাগের জন্য বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত আলটিমেটাম দেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। না হলে আমরণ অনশন পালন করবেন বলে জানানো হয়।
১৯ জানুয়ারি
সকাল ১০টায় উপাচার্য গণমাধ্যমকে বলেন, ২ ফেব্রুয়ারির বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট নির্বাচন স্থগিত। পদত্যাগের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন। এরপর বিকেল ৩টা থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। রাত সাড়ে ৮টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিনিধিদল শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙাতে এসে ব্যর্থ হয়ে সাড়ে ১১টার দিকে ফিরে যান।
২০ জানুয়ারি
বেলা ১টায় উপাচার্যের বাসভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলনের সর্বশেষ অবস্থা ও পরবর্তী কার্যক্রম তুলে ধরেন শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে বেলা দেড়টার দিকে অনশনকারীদের মধ্যে প্রথম একজন অসুস্থ হন। রাত ১১টায় উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে মশাল মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা।
২১ জানুয়ারি
আওয়ামী লীগ নেতারা এসে শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙানোর চেষ্টা করেন। এদিন ৩টা ৬ মিনিটের দিকে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ফোনালাপ হয়। আলোচনার জন্য শিক্ষার্থীদের ঢাকায় যাওয়ার আহ্বান জানান মন্ত্রী। পরে সন্ধ্যা ৬টায় সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থী শাহেরিয়ার আবেদীন বলেন, মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় ঢাকা যাবেন না শিক্ষার্থীরা। ভার্চুয়ালি আলোচনার প্রস্তাব দেন তারা। এদিন মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার জন্য শিক্ষকরা রাত ১১টার দিকে ঢাকায় যান।
২২ জানুয়ারি
বিকেল ৩টার দিকে কাফনের মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিটের দিকে হেয়ার রোডে শিক্ষামন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে শিক্ষকদের বৈঠক হয়। রাত ৮টা থেকে গণঅনশন কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। রাত ১২টা ৪০ মিনিটে শিক্ষামন্ত্রীর বার্তা নিয়ে ক্যাম্পাসে আসেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল ইসলাম চৌধুরী নাদেল। দিবাগত রাত ১টার পরে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে ভার্চুয়াল আলোচনায় বসেন শিক্ষার্থীরা। আলোচনায় উপাচার্যের পদত্যাগের কোনো বার্তা পাননি শিক্ষার্থীরা।
২৩ জানুয়ারি
এদিন সকাল থেকে রোড পেইন্টিং, গ্রাফিতি, দেয়াললিখন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে উপাচার্যের বাসভবনের পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ বিছিন্ন করেন শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে অনশনকারী রাতুলের অস্ত্রোপচার হয় রাত পৌনে ১১টায়। এছাড়া অসুস্থ হয়ে অনশনরত ১৬ জন শিক্ষার্থী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।
২৪ জানুয়ারি
ক্যাম্পাসে ঢোকার ক্ষেত্রে স্বাক্ষর করে ঢুকতে হবে—এ পদ্ধতি চালু করেন শিক্ষার্থীরা। বেলা ১টায় সংবাদ সম্মেলন করেন শিক্ষার্থীরা। এতে বহিরাগতদের ইন্ধন বা অংশগ্রহণের অভিযোগের প্রতিবাদ করেন তারা। সন্ধ্যা ৫টা ৫৫ মিনিটে ভিসির জন্য খাবার দিতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হন প্রক্টর। এর আগে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের দুই কাউন্সিলরও খাবার নিয়ে এসে ফেরত যেতে হয়েছে। রাতে ভিসির বাসভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ পুনরায় চালু করে দেওয়া হয়।
২৫ জানুয়ারি
শিক্ষকরা খাবার নিয়ে ভিসি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি। অবশ্য শিক্ষকদের যেতে দেওয়া না হলেও পুলিশের মাধ্যমে খাবার পৌঁছানো হয় উপাচার্যের বাসায়। অনশনকারী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের খাবার রাখেননি। বিকেলে গোলচত্বরে মুক্ত আলোচনায় অনশনকারীদের অনশন ভাঙানোর সিদ্ধান্ত নেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে শপথবাক্য পাঠ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে সন্ধ্যায় অনশনকারীদের অনশন ভাঙাতে অনুরোধ করলে তারা রাজি হননি। ফের সংবাদ সম্মেলন করে অনশন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। দিবাগত রাতে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ক্যাম্পাসে আসছেন শুনে পুলকিত হন শিক্ষার্থীরা। দিবাগত রাত ৪টার দিকে অনশনকারীদের কাছে আসেন কথাসাহিত্যিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হক। তারা অনশনকারীদের সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টা আলাপ করেন। এরপর জাফর ইকবালের আশ্বাসে অনশন ভাঙতে রাজি হন শিক্ষার্থীরা।
২৬ জানুয়ারি
সকাল ১০টার দিকে ড. জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী সবাইকে পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙান। এ সময় শিক্ষার্থীরা আবেগাপ্লুত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অবশ্য অনশন ভাঙলেও ভিসির পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। নতুন করে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।