• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫

রাবিতে আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব, নেপথ্যে কারা?


সৈয়দ সাকিব, রাবি
প্রকাশিত: মার্চ ১৮, ২০২৩, ১১:২৭ এএম
রাবিতে আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব, নেপথ্যে কারা?

বাসের সিটে বসাকে কেন্দ্র করে গত শনিবার বগুড়া থেকে রাজশাহীগামী মোহাম্মদ পরিবহন নামের একটি বাসের চালক ও হেলপারের সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর বাজারের স্থানীয় ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে শুরু হয়। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ক্যাম্পাস সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকা। প্রায় ৫ ঘণ্টাব্যাপী এ সংঘর্ষে উভয়পক্ষে অন্তত ২৫০ জন আহত হন।

ছাত্রলীগই দায়ী, বলছে বাম সংগঠনগুলো

তুচ্ছ এই ঘটনা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেওয়ার পেছনের কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উভয়পক্ষের নেতৃত্বেই ছিল ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। প্রত্যক্ষদর্শী ও ক্যাম্পাসের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো বলছে, সেই দিনের হাতাহাতির ঘটনা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেওয়ার নেপথ্যে ছিল ক্ষমতাসীনদের আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব। সংঘর্ষের এই ঘটনার পুরো দায় ছাত্রলীগ ও স্থানীয় ক্ষমতাসীনদের দাবি করে গত মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ৮টি ছাত্র সংগঠন প্রেস বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেন।

রক্তক্ষয়ী এই সংঘর্ষের একদিকে শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান ছিল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের। অন্যদিকে স্থানীয়দের পক্ষে ছিলেন মহানগর ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এতে সংঘর্ষটি আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে বলে দাবি করেছেন এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্টরা।

ছিল পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, যোগ দেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা

সংঘর্ষের নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১১ মার্চ বগুড়া থেকে রাজশাহীগামী মোহাম্মদ পরিবহনের বাস সহকারীর সঙ্গে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আল-আমিন আকাশের বাকবিতণ্ডা হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর ফটকে বাস পৌঁছালে সেখানে ওই বাস সহকারী ও আল-আমিন আকাশের বন্ধুদের হাতাহাতি হয়। সেখানে বিনোদপুরের কিছু ব্যবসায়ী আকাশের বন্ধুদের উপর মারমুখী হলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া উপস্থিত হয়। পরে সেখানে গোলাম কিবরিয়ার নেতৃত্বে কয়েকজন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ বাঁধে। একপর্যায়ে স্থানীয়দের ধাওয়া খেয়ে সরে আসতে বাধ্য হয় ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ কর্মীদের এই সংঘর্ষ সাধারণ ‘শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষ’ হিসেবে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার হলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। এর পরপরই শুরু হয় শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ঘটনা ঘটার ১ ঘণ্টা পর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান মিশু, সহ-সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সভাপতি কাবিরুল ইসলাম রুহুল, সাধারণ সম্পাদক আলফাত সায়েম জেমস, উপমুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক নিহাদ, জিয়াউর রহমান হল সভাপতি রাশেদ আলী, সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম, নবাব আব্দুল লতিফ হল সভাপতি শুভ্র দেব ঘোষ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল শাখার সহসভাপতি মেজবাহ, সাখাওয়াত হোসেন শাকিল, খালিদ সাইফুল্লাহ, মতিহার হলের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহাসহ ছাত্রলীগের প্রায় শতাধিক নেতাকর্মী স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এতে ছাত্রলীগের অন্তত ৩৫ নেতাকর্মী আহত হন বলে ছাত্রলীগ সভাপতি গোলাম কিবরিয়া দাবি করেন।

অন্যদিকে সংঘর্ষে বিনোদপুরে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নেতৃত্বে ছিলেন, মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি অনিক মাহমুদ বনি, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও বিনোদনপুর বাজার সমিতির সভাপতি শহিদুল ইসলাম শহিদ, থানা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ও বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক আকরাম । তাদের নেতৃত্বে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা একযোগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ও শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান বলে অভিযোগ করেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

মূলত এ হামলা বিনোদপুরের সাধারণ ব্যবসায়ী কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। উভয়পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাকর্মী ঢুকে যাওয়ায় এ সংঘর্ষ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।

তবে এই সংঘর্ষের ঘটনায় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও অনিক মাহমুদ বনি। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে আমার নিজের দলের অনেক নেতাই আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। এই সহিংসতার সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেন এই নেতা।”

এই ঘটনায় কোনো পক্ষের উস্কানি ছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে অনিক মাহমুদ বনি বলেন, “সেই দিন কী ঘটনা ঘটেছে সেটা বিনোদনপুর গেইটে সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ দেখলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে। কারা মোটরসাইকেল, পুলিশ বক্স ও দোকানে আগুন দিয়েছে। ওই সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতেই এই ঘটনা ঘটেছে। চারুকলার ডামি পুড়িয়ে রেললাইন অবরোধ ও রেললাইনের স্লিপার উঠানোসহ বিভিন্ন কার্যক্রম প্রমাণ করে এই সংঘর্ষে কারা ছিল। এই ঘটনাটি যারাই ঘটিয়েছে আমরা চাই দোষীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া হোক। সেটা হোক শাখা ছাত্রলীগ, স্থানীয় বা অন্য যে কেউ।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী এক ব্যবসায়ী বলেন, “রাজনীতির মারপ্যাঁচে আমরা সাধারণ ব্যবসায়ীরা নিঃস্ব হলাম। অন্যদিকে রক্ত ঝরল বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের। মামলা তো হয়েছেই, তদন্তও হবে। তবে রাজনীতির কারণেই ঘটনার মূলহোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে।”

রাকসু আন্দোলন মঞ্চের আহ্বায়ক আব্দুল মজিদ অন্তর বলেন, “আন্দোলনের দিন প্রশাসন ভবনে তালা দিয়ে অবস্থান ও বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ভিসি স্যারের বাসভবনের সামনে অবস্থান করা পর্যন্ত আন্দোলন শান্তিপূর্ণ চলছিল। কিন্তু হঠাৎ  ভিসিকে অবরুদ্ধ করা, সাংবাদিকদের  ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এগুলো আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকেই হচ্ছিল। সংগত কারণেই মনে হয়েছে কোনো একটি মহল আন্দোলনকে উস্কে দিচ্ছে।”

সংঘর্ষের ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, “অভিযোগ তো যে কেউই করতে পারে। আমি ঘটনাস্থলে যাই সংঘর্ষের এক ঘণ্টা পর, সেখানে আমাদের বাইকগুলোও পুড়িয়ে দেয় স্থানীয়রা। ক্যাম্পাসে কোনো সমস্যা তৈরি নয়, আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানেই চেষ্টা করি। শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ নিয়েই ওইদিন কাজ করেছে। সংঘর্ষের শুরু থেকেই প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরব ভূমিকার কারণেই সংঘর্ষটি রক্তক্ষয়ী রূপ ধারণ করেছে।”

নগরীর মতিহার থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম বলেন, “স্থানীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে মোট ৮০০ জনের নামে মামলা করা হয়েছে। মামলাগুলো সব অজ্ঞাতনামা। আমরা একজনকে আটক করেছি। জড়িত অন্যদেরও আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।”

তবে সংঘর্ষের ঘটনায় রাজনৈতিক কোনো বিষয় জড়িত আছে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি।”

এদিকে গত রোববার রাতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের পাশে রেললাইন অবরোধ করে আগুন দেওয়ার নেতৃত্বে ছিল ছাত্রলীগ।

প্রত্যক্ষদর্শী কয়েক শিক্ষার্থী বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের মন্নুজান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি জান্নাত জারাসহ আগুন দেওয়ার পেছনে বেশ কয়েকজন জড়িত ছিল। পরে এর সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীও যুক্ত হয়।”

আন্দোলনের পর সার্বিক বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, “শিক্ষার্থীদের সকাল থেকে যে আন্দোলন হয়, প্রথম দিকে আমাদের শিক্ষার্থীরাই ছিল। শিক্ষার্থীদের যেকোনো আন্দোলন অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি বিষয়। কিন্তু সহিংসতা, জ্বালাও-পোড়াও কার্যক্রমে বহিরাগতরা যুক্ত ছিল বলে আমার কাছে তথ্য আছে। এর কারণেই পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। শিক্ষার্থীদের সকল আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবেই হয়। একপর্যায়ে আমরা তাদের দাবিগুলো পূরণ করব।”

উপাচার্য আরও বলেন, “বর্তমানে ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এখানে সবাই আসবে। কিন্তু কোনো বিশৃঙ্খলা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেব। এখন থেকে সন্ধ্যার পর বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে অবস্থান করতে দেওয়া হবে না।”

এর আগে গত শনিবার বাসের সিটে বসাকে কেন্দ্র করে কথা-কাটাকাটির জেরে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর বাজারে স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে স্থানীয়রা মহাসড়ক অবরোধ করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এতে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে অবস্থান নেন। সংঘর্ষে আহত হন অন্তত ২৫০ জন শিক্ষার্থী।

Link copied!