• ঢাকা
  • রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সৌদি খেজুর চাষে কোটিপতি ভালুকার মোতালেব


ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: মার্চ ১২, ২০২২, ০৮:৩৮ এএম
সৌদি খেজুর চাষে কোটিপতি ভালুকার মোতালেব

বাংলাদেশের মাটি যে সোনাফলা, সেটা ভালোই উপলব্ধি করেছিলেন আব্দুল মোতালেব। তাই সাহস করেছিলেন মরুর দেশের খেজুর বীজ এনে দেশে ফলানোর। ময়মনসিংহের ভালুকার হবিরবাড়ি ইউনিয়নের পাড়াগাঁও গ্রামের এই মানুষটি শুধু সুস্বাদু ও মিষ্টি খেজুরই ফলাননি, মাত্র সাতটি গাছ থেকে হাজার হাজার চারা তৈরি করে ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বিদেশের মোহ ছেড়ে দেশে এসে হয়েছেন কোটি টাকার মালিক।

অভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে সৌদি আরব গিয়েছিলেন আব্দুল মোতালেব। ১০ হাজার টাকা বেতনে খেজুরবাগানে চাকরি নিয়েছিলেন। চাষাবাদ রপ্ত করে তিন বছরের মাথায় দেশে ফেরেন। সঙ্গে আনেন খেজুরের বীজ। বাগান করে কয়েক বছরের মধ্যে বদলে ফেলেন ভাগ্য। এখন বছরে কোটি টাকার চারা ও খেজুর বিক্রি করেন তিনি।

আব্দুল মোতালেব (৫৪) ময়মনসিংহের ভালুকার পাড়াগাঁও গ্রামের মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে। তিনি সফল উদ্যোক্তা। সবাই তাকে ‘খেজুর মোতালেব’ বলে ডাকেন।

মোতালেব বলেন, “দেশে ফিরে আমার বাড়ির পাশে একটি জমিতে খেজুরের চারা রোপণ করি। কিন্তু প্রায় সব গাছই পুরুষ হয়ে যাওয়ায় খেজুর হয়নি। আবার গাছ লাগালে আবারও একই অবস্থা। তৃতীয় দফায় আমি সফল হই। এবার দুটি গাছে খেজুর হয়। সেই দুই গাছ থেকে আজ প্রায় ১২০০ চারা উৎপাদন করেছি। বর্তমানে প্রায় ১০০টি গাছে খেজুর ধরেছে। চলতি বছর ৫ লাখ টাকার খেজুর বিক্রি করেছি।”

কোনো কিছুতে সহজে হাল না ছাড়া মোতালেব বলেন, “লোকে বিদেশে গেলে সুটকেস-ভর্তি জিনিস নিয়ে আসে, আর আমি আনছিলাম খেজুর। দেশের মানুষ হাসাহাসি করত, পাগল বলত। আমার দেওয়া বীজ থেকে ২৭৫টি চারা বের হয়। চারাগুলো সাইজ করে লাগাইনি। তিন বছর তো বেশি সময় না, মুকুল এলে চারা লাগাব। শুরু করি ২০০১ সালে। ১৭ মাস পর একদিন আমার স্ত্রী এসে বলল, তোমার গাছে মুকুল আইছে। আমি তো বিশ্বাসই করিনি। পরে বাজি ধরে গিয়ে দেখি সত্যি মুকুল বের হয়েছে, কিন্তু পুরুষ। তখন একটা সাহস এলো পুরুষ মুকুল যখন আসছে তখন মেয়েও হবে। সেটা চৈত্র মাসের ১৭ তারিখ ছিল। বৈশাখে একটা এলো সেটাও পুরুষ। পরের বছর পাঁচটা, তারপরের বছর সাতটা, তার পরেরবার নয়টা গাছে মুকুল এলো, সবগুলো পুরুষ। তবু হতাশ হইনি। তবে টেনশন বাড়ছিল।”

“হাল ছাড়ছিলাম না। পরের বছর ১১টা গাছের মধ্যে একটা গাছে মেয়ে মুকুল এলো। তুলে আলাদা করে লাগালাম। এই গাছটাই শাইখ সিরাজের নামে রাখলাম। আজোয়া গাছ। এটাই বাংলাদেশে প্রথম সৌদি খেজুরগাছ। প্রতিবছর তিনি আসেন একবার। তার কাছে অনেক ঋণ আছে বলেই এটা ওনার নামে রেখেছি।”

এই উদ্যোক্তা আরও বলেন, “এখন আমি কাটিং জানি। নারী গাছগুলো থেকে গজানো চারা নারীই হয়। সেগুলো পুরুষ গাছে কাটিং করে বসানো যায়। এটা সারা বাংলাদেশে আমার মতো কেউ পারে না। আমার সব গাছ কাটিং করে মেয়ে বানাইছি।”

চারা বিক্রির টাকায় তিনি বাগানের উন্নয়নসহ সংসারের নানা চাহিদা পূরণে সমর্থ হন। তিনি জানান, ছোট আকৃতির প্রতিটি চারা ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা, ফলধারক একটি গাছ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে থাকেন। তার বাগানে বর্তমানে ১২০০ ছোট-বড় গাছ রয়েছে। এর মধ্যে ৭০-৮০টি গাছে এ বছর খেজুর ধরেছে। প্রতিটি পূর্ণ বয়স্ক গাছে ১২ থেকে ১৩টি কাঁদি হয়। প্রতিটি কাঁদিতে ১০ থেকে ১২ কেজি খেজুর পাওয়া যায়। আজুয়া জাতের খেজুর প্রতি কেজি ২ হাজার টাকা, আমবাগ প্রতি কেজি ২ হাজার টাকা, সুকারী ১ হাজার ৫০০ টাকা, বরকি ১ হাজার ৫০০ টাকা কেজি বিক্রি হয়। 

মোতালেব একসময় স্ত্রী সন্তান নিয়ে মাটির ঘরে বসবাস করতেন। খেজুরবাগান থেকে আয়ে তিনি দোতালা ভবন করেছেন। ৬ বিঘা জমি কিনেছেন, যার মূল্য বর্তমানে কোটি টাকার ওপরে। 

আজওয়া, ছুক্কারী, আমবাগ, বারহী এবং বকরী জাতের সৌদি খেজুরের মতোই মোতালেবের বাগানের খেজুরের আকার ও স্বাদ। বাজারে এর চাহিদাও বেশ। মোতালেবের বাগানের প্রতি কেজি খেজুর বিক্রি হয় ১ থেকে ২ হাজার টাকা। 

তার বাগানে কর্মচারী আছে ১৫ জন। সারা বছর কাজ করে। একেকজনের মাসে ১৫ হাজার টাকা বেতন দেওয়া লাগে। বাগান করতে গিয়ে ছয় বিঘা জমি বিক্রি করছিলেন। আবার কিনেছেন। এখন বছরে ৫০ লাখের মতো আয় হয় তার। আবার খরচও আছে। বাড়তি হিসেবে খেজুরের পাশাপাশি আদা ও কচু লাগান। এ থেকে বছরে আসে ১০-১২ লাখ টাকা।

Link copied!