এক সময় ব্যাংক ও ট্যাংকের শহর হিসেবে কুমিল্লা নগরীর খ্যাতি ছিলো। সেই কুমিল্লা নগরীতে দিন দিন দখল, দূষণ আর অযত্নে ভরাট হচ্ছে পুকুর ও দিঘীগুলো। রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনের নীরবতায় কুমিল্লা নগরীতে গত ত্রিশ বছরে শতাধিক পুকুর-দিঘী ও জলাধার ভরাটের ঘটনা ঘটেছে। এক্ষেত্রে কুমিল্লার পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। সিন্ডিকেট করে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকায় দিঘী, পুকুর, জলাধার ভরাটের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। নগরীর দক্ষিণাংশ ছাড়া দেড়শ পুকুর-দিঘীর মধ্যে বর্তমানে ৫০টিরও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না ব্যাংক ও ট্যাংকের শহর কুমিল্লায়।
নাগরিক সমাজ ও পরিবেশবিদরা মনে করছেন নগরীতে বর্তমানে যেসব পুকুর দিঘী রয়েছে তা সংরক্ষণের পাশাপাশি নতুন করে পুকুর-দিঘী খননের উদ্যোগ ভবিষ্যতের জন্য বিপর্যয় মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করবে। এ নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন নগরীর সচেতন বাসিন্দারা।
সূত্রমতে, ভরাট হয়ে যাচ্ছে নগরীর তিনশ বছরের পুরানো ছোটরা জংলিবিবি পুকুর। এ পুকুরের উত্তর পাশে রাতের আঁধারে চলে ভরাটের কাজ। সম্প্রতি নগরীর আরেকটি ৩০০ বছরের প্রাচীন উজির দিঘী। সম্প্রতি দিঘীটি ভরাট চেষ্টার অভিযোগ ওঠে।
নগরবাসীর প্রতিবাদের মুখে বর্তমানে সেটির কাজ বন্ধ রয়েছে। কাপ্তান বাজার এলাকার কয়েকটি পুকুর ময়লা আবর্জনা ফেলে কৌশলে ভরাট করা হচ্ছে। নগরীর পুরাতন চৌধুরীপাড়ার টিএন্ডটি অফিসের পুকুরটি অযত্নে মরতে বসেছে। কচুরিপানা জমাট বাঁধা পুকুরে বেড়ে উঠছে কলা গাছ। এটি সর্বশেষ করে সংস্কার হয়েছে তা কেউ জানে না।
ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবির বলেন, নগরীর বজ্রপুর ইউসুফ স্কুল রোডে অজিতগুহদের একটি পুকুর, মোহিনী মোহন বর্ধনের বাড়ির সামনের পুকুর, ইউসুফ স্কুলের ভেতরের পুকুর, ডা. নিত্যহরির বাড়ির ভেতরের পুকুর, কাজী বাড়ির পুকুর, প্রয়াত বাদল হাজরার বাড়ির পাশের পুকুর ছিলো। সেগুলো ভরাট হয়ে গেছে। পাকিস্তান আমলে ভরাট হয়ে গেছে ইপিজেড রোডের আনন্দ সাগর দিঘীটি। ৭০ দশকের পর ভরাট হয়েছে শাসনগাছা ডাক বাংলো দিঘী। তালপুকুরপাড়ে দুটি পুকুর আর নেই, হারিয়ে গেছে রায় বাড়ির পুকুর, ভিক্টোরিয়া কলেজের কমন রুমের পাশের পুকুর, ক্ষিতি দত্তের পুকুর, সারদা পাল মাঠের পুকুর, ঠাকুরপাড়া জোড় পুকুর, লালা পুস্কুরনী, ঝাউতলা কামিনী কুটিরের পাশের পুকুর, খ্রিষ্টান পাড়ার পুকুর, পার্কের ভেতরে ব্যাঙ সাগর। পুরো নগরীতে গত একশত বছরে শত শত পুকুর ভরাট হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন কুমিল্লার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম বলেন, ব্যক্তি মালিকানার দোহাই দিয়ে অনেকে পুকুর দিঘি ভরাট করছেন। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পুকুর দিঘীর প্রয়োজন রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজনে পুকুর ও দিঘী অধিগ্রহণ করতে পারে। তারপর দেখভালের জন্য সেগুলো লিজ দিতে পারে। এছাড়া কচুরিপানায় মরতে বসা পুকুরগুলো সংস্কার করতে পারে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপ-পরিচালক শওকত আরা কলি বলেন, “ছোটরা জংলিবিবি পুকুর ভরাট নিয়ে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছি। উজির দিঘীর বিষয়েও আমরা অবগত রয়েছি। অন্যান্য ক্ষেত্রে লিখিত অভিযোগ পেলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. মনিরুল হক সাক্কু বলেন, “যেখান থেকেই অভিযোগ পাচ্ছি সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছি। অনেক সময় কাউন্সিলরদের পাঠাচ্ছি ভরাট বন্ধ করতে। আমরা সবাইকে সতর্ক করছি। এভাবে পুকুর ভরাট করার কোন সুযোগ নেই, এটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। প্রয়োজনে শিগগিরই এসব ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করবে সিটি করপোরেশন।”
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, “আমরা কয়েক মাস আগে নগরীর কয়েকটি পুকুর পরিষ্কার করেছি। পুকুর-দিঘী পরিষ্কার করার উদ্যোগটি আবার গ্রহণ করবো। নগরীতে কোনো পুকুর-দিঘী ভরাট করতে দেয়া হবে না।”