‘জন্মের পর থেকে এভাবে নৌকা দিয়ে পারাপার হয়ে আইতেছি। এখানে ব্রিজ আজকে হবে, কালকে হবে-এভাবেই শুনে আইতেছি। ব্রিজ না হওয়ায় আমরা কৃষিপণ্য নিয়ে সময়মতো হাটে যেতে পারি না। মাথায় করে এপারের পণ্যগুলো ওপারে নিতে হয়। সবাই আশা দেয়, কিন্তু কেউ আমাদের কথা রাখে না।’
ক্ষোভ নিয়ে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেনন কৃষক মিজান মিয়া (৬০)। তিনি টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের সিঙ্গারডাক গ্রামের বাসিন্দা। জেলার দুই উপজেলা বাসাইল ও মির্জাপুর। এপারে বাসাইলের কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের সিঙ্গারডাক গ্রাম, ওপারে মির্জাপুরের তরফপুর ইউনিয়নের পাথরঘাটা গ্রাম। মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে বংশাই নদ। বংশাই পার হয়ে এপার থেকে ওপার যেতে হয় প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার মানুষকে। সেতু না থাকায় তাদের ভরসা নৌকা। স্থানীয়দের দীর্ঘদিনের দাবি, দুই গ্রামের মাঝে একটি সেতু হোক।
স্থানীয়রা জানান, নদীর এক পারে অবস্থিত বাসাইল উপজেলায় দুটি কলেজ, দুটি উচ্চ বিদ্যালয়। উপজেলার সিঙ্গারডাক এলাকায় একটি উচ্চ বিদ্যালয় ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। অন্যদিকে, মির্জাপুর উপজেলার পাথরঘাটা এলাকায় রয়েছে একটি উচ্চ বিদ্যালয়, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি কিন্ডারগার্টেন। পাথরঘাটায় সপ্তাহে দুই দিন হাট বসে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের রয়েছে নদী পার হওয়ার ঝুঁকি। তারপর প্রতিদিন একজন শিক্ষার্থীকে আসা-যাওয়া বাবদ ২০ টাকা নৌকা ভাড়া দিতে হয়। আর কৃষককে তার কৃষিপণ্য নিয়ে নদীপারে মুখোমুখি হতে হয় বাড়তি খরচ ও ভোগান্তির।
তারা আরও জানান, মির্জাপুর উপজেলার তরফপুর ইউনিয়নের আটগ্রাম এবং বাঁশতৈল ইউনিয়নের কিছু লোক ওই দুই গ্রামের মাঝের ঘাট দিয়ে নৌকায় করে নদী পারাপার হয়। অন্যদিকে বাসাইল উপজেলার কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের সিঙ্গারডাক, পূর্ব পৌলী, যৌথকী, জিগাতলীসহ ১২টি এলাকার মানুষ একই এলাকার ঘাট দিয়ে নদী পার হয়।
এ ছাড়া কাউলজানী ও বাসাইল সদর ইউনিয়নের কিছু লোক নদী পার হয় একই ঘাট দিয়ে। শুকনো মৌসুমে বাঁশের সাঁকো আর বর্ষা মৌসুমে একমাত্র ভরসা নৌকা। ফলে ঝুঁকি নিয়ে নদী পারাপার হতে হয় শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষকে।

পাথরঘাটা এলাকার কৃষক মিনহাজ উদ্দিন বলেন, “আমার বাড়ি এই পারে। জমির ফসল ঘরে আনতে বাসাইলের সিঙ্গারডাক যেতে হয়। একদিকে যেমন টাকা বেশি লাগছে অন্যদিকে সময়ও বেশি লাগছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকলে সময়ও কম লাগত, টাকাও খরচ কম হতো।“
মিনহাজ আরও বলেন, “আমাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। একটা রোগী নিয়ে হাসপাতালে যেতে নৌকার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। সময়মতো রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি না। রাতেও নৌকা ঠিকমতো পাওয়া যায় না। নৌকা পেলেও দ্বিগুণ টাকা গুনতে হয়। আমাদের এখানে একটা ব্রিজ হলে আর কোনো কষ্ট থাকত না।”
বাসাইল উপজেলার সিঙ্গারডাক আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মফিজুর রহমান বলেন, “এখানে প্রতিদিন কয়েক হাজার লোক পারাপার হচ্ছে। তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। আমাদের বর্ষা মৌসুমে বেশি কষ্ট হয় কচুরিপানা আটকে থাকে। তখন নৌকা চলাচল করতে পারে না। রোগী নিয়ে হাসপাতালে সময়মতো যেতে পারে না। দুই মিনিটের রাস্তা। কিন্তু ঘুরে যেতে সময় লাগে এক ঘণ্টার ওপরে।”
তিনি বলেন, “দুই পাশে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। শিক্ষার্থীরা ঝুঁকি নিয়ে নদী পারাপার হয়। বর্ষাকালে প্রচুর পানি এবং শুকনো মৌসুমে ভাঙাচোরা পথে ধুলোবালি থাকে। সেতু না থাকায় আমাদের প্রচুর সমস্যা হচ্ছে।”
শিক্ষার্থী মাহিম মিয়া বলে, “আমার বাড়ি বাসাইল উপজেলার সিঙ্গারডাক গ্রামে। আমি এই নদী পার হয়ে পাথরঘাটা স্কুলে যাই। অনেক সময় নৌকার জন্য সময়মতো পরীক্ষায় অংশ নিতে পারি না। আবার ক্লাসে যাব, কিন্তু নৌকা সময়মতো ধরতে না পারলে সঠিক সময়ে ক্লাসে যেতে পারি না। আমরা ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করি এ নদী দিয়ে। আমাদের কষ্টের শেষ নেই।”
কাঞ্চনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শামীম আল মামুন বলেন, “এখানে একটি সেতু অনুমোদন হয়েছে। টেন্ডার প্রক্রিয়ার পথে। কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি, যেন দ্রুত সেতুর কাজ শুরু হয়। সেতুটি হয়ে গেলে দুই উপজেলাবাসীর কষ্ট দূর হবে।”
টাঙ্গাইলের স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, “পাথরঘাটা সেতুর প্রস্তাব রয়েছে। সেটা নকশার পর্যায়ে। নকশা সম্পন্ন হয়ে গেলে টেন্ডারের প্রক্রিয়া শুরু হবে। আশা করি, মাসখানেকের মধ্যেই নকশা সম্পন্ন হবে।”
                
              
																                  
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    




































