প্রাচীন স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার আটিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত আতিয়া জামে মসজিদ। চারশ বছরের পুরোনো এই মসজিদটি এখনো সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে দীর্ঘদিন কোনো সংস্কার না হওয়ায় তা অবহেলায় পড়ে আছে। এটি তত্ত্বাবধান করছে প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর বিভাগ। স্থানীয়দের দাবি সংস্কারসহ ১০ টাকার নোটে আবারও ফিরিয়ে আনা হোক আতিয়া মসজিদের ছবি।
জানা যায়, ১৯৭৮ সালে ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদে প্রথম আতিয়া মসজিদটি স্থান পায়। এরপর ১৯৮২ সালে পরিবর্তিত ১০ টাকার নোটের প্রচ্ছদেও স্থান পায় আতিয়া মসজিদ। এতে দেশবাসীর মাঝে সহজেই মসজিদটি পরিচিতি লাভ করে। মসজিদটি শুধু ঐতিহ্যের নিদর্শনই নয়, একটি দর্শনীয় স্থানও। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এখানে ঘুরতে আসেন। ইতিহাসখ্যাত বারো ভূঁইয়ার এক ভূঁইয়া ঈশা খাঁর ছেলে মুসা খানের শাসনামলে মসজিদটি নির্মিত হয়।
ঈশা খাঁর রাজধানী ছিল সোনারগাঁ। তিনি ছিলেন সোনারগাঁ অঞ্চলের শাসক। বৃহত্তর ঢাকা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ তখন সোনারগাঁও অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল। শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে ঈশা খাঁ টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার আতিয়ায় পরগনা সৃষ্টি করেন। সে সময় আতিয়া পরগনার শাসনভার ন্যস্ত হয় ঈশা খাঁর ছেলে মুসা খাঁর ওপর।
টাঙ্গাইল শহরের দক্ষিণ পশ্চিমে ৭ কিলোমিটার দূরে লৌহজং নদীর তীরে ঐতিহাসিক এই মসজিদটির অবস্থান। এর নির্মাণ প্রায় ৪০০ বছর আগে হলেও মসজিদটি প্রাচীন স্থাপত্যের এক অনন্য শিল্পকর্মের নিদর্শন হওয়ায় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রাচীন এই মসজিদটির আয়তন বাইরের দিকে ২০ দশমিক ৯ মিটার ও ১৬ দশমিক ১৩ মিটার। মসজিদের প্রাচীর ২ দশমিক ৭২ মিটার (দশমিক ৫ ফুট) প্রশস্ত বা দৈর্ঘ্য ৪২ ফুট, প্রস্থ ৩২ ফুট এবং উচ্চতা ৪৪ ফুট।
মসজিদের চার কোণায় রয়েছে চারটি বিশাল আকারের অষ্টকোণাকৃতির মিনার। স্ফীত রেখার সাহায্যে অলংকৃত মিনারগুলো ছাদের অনেক ওপরে উঠে গেছে। চূড়ায় রয়েছে কারুকার্যময় সুন্দর ছোট ছোট গম্বুজ। গম্বুজগুলোর গায়ে বিভিন্ন রকমের কারুকার্য মসজিদটির সৌন্দর্য অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
মসজিদটির প্রধান কক্ষ ও বারান্দা দুই ভাগে বিভক্ত। মসজিদের পূর্ব ও মাঝের দেয়ালে রয়েছে একটি করে দরজা। বারান্দাসহ উত্তর-দক্ষিণ দেয়ালে রয়েছে দুটো করে দরজা। ভেতরের পশ্চিম দেয়ালে আছে ৩টি সুন্দর মেহরাব। প্রধান কক্ষের প্রত্যেক দেয়ালের সঙ্গে দুইটি করে পাথরের তৈরি স্তম্ভ আছে। প্রধান কক্ষের ওপরে রয়েছে একটি বিশাল মনোমুগ্ধকর গম্বুজ। বারান্দার পূর্ব দেয়ালে রয়েছে তিনটি প্রবেশ পথ। মাঝখানের প্রবেশপথের ওপরের অংশের নিম্নভাগে একটি শিলালিপি রয়েছে। বর্তমানে যে শিলালিপিটি রয়েছে এর আগেও সেখানে একটি শিলালিপি ছিল বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। এই শিলালিপিটি ফার্সিতে লেখা। কোনো কারণে আদি শিলালিপিটি বিনষ্ট হলে পরবর্তী সময়ে মসজিদ মেরামতের সময় বর্তমান শিলালিপিটি লাগানো হয়। বর্তমান শিলালিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আতিয়া মসজিদ নির্মাণ হয় ১০১৮ হিজরিতে।
১৬০৯ সালে বায়েজিদ খান পন্নীর ছেলে সাঈদ খান পন্নী মসজিদটি নির্মাণ করেন। টাঙ্গাইলের করটিয়ার বিখ্যাত পন্নী জমিদার বংশের আদি পুরুষ হলেন সাঈদ খান পন্নী। মসজিদের পশ্চিম দিকে অবস্থিত ফটকের ডানদিকে আরেকটি শিলালিপি আছে। ইংরেজিতে লেখা এই শিলালিপি পাঠে জানা যায়, ১৬০৯ সালে সাঈদ খান পন্নী এটি নির্মাণ করেন। এরপর ১৮৩৭ সালে মসজিদটি সংস্কার করেন দেলদুয়ার জমিদার বাড়ির সদস্য রওশন খাতুন চৌধুরাণী। পরে দেলদুয়ারের জমিদার আবু আহম্মদ গজনবী ও করটিয়ার জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীসহ কয়েকজন মিলে ১৯০৯ সালে পুনরায় মসজিদটি সংস্কার করেন। বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরের অধীনে মসজিদটির তত্ত্বাবধায়ন করা হচ্ছে।
দর্শনার্থীরা জানান, ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদটি সংস্কারের পাশাপাশি সুন্দর ব্যবস্থাপনা দরকার। এখানে সব ধরনের মানুষ ঘুরতে আসেন। একসময় দশ টাকার নোটে যেভাবে মসজিদটির ছবি ছিল, পুনরায় দশ টাকার নোটে মসজিদটির ছবি ছাপানোর আহ্বান জানিয়েছেন তারা । যেন নতুন প্রজন্ম জানতে পারে দশ টাকার নোটে এই মসজিদের ছবি ছিল।
কুমিল্লা থেকে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী সাদ্দাম হোসেন বলেন, “অনেক বছরের পুরাতন এই মসজিদে এসে নামাজ আদায় করেছি। খুব ভালো লেগেছে। ইতিহাস ঐতিহ্যের এই মসজিদটি এখনো অনেক সুন্দর। দর্শনার্থী বাড়াতে মসজিদটির সংস্কার করা দরকার। এটি অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে। সরকারের কাছে দাবি অতি দ্রুত মসজিদটি সংস্কার করা হোক।”
সাভার থেকে ঘুরতে আসা সাদেক আলী বলেন, “আগের দশ টাকার নোটে দেখেছিলাম এই মসজিদের ছবি। তারপর ইচ্ছে হলো এই মসজিদ দেখার। দেখে অনেক ভালো লেগেছে। সরকারের কাছে দাবি সংস্কারসহ দশ টাকার নোটে আবারও ফিরিয়ে আনা হোক আতিয়া মসজিদের ছবি।”
স্থানীয় জব্বার মুন্সী বলেন, “সংস্কার না করার কারণে মসজিদটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সরকার দেশের অনেক উন্নয়ন করেছে, আমাদের এই মসজিদ সংস্কার করে দিলে আরও সুন্দর হবে। এই মসজিদটি দশ টাকার নোটে ছিল যেন নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা ঐতিহ্য জানতে পারবে ও দেখতে পারে। সরকারের কাছে এটি দাবি আমাদের।”
দেলদুয়ার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা আলী বলেন, “সংস্কারের অভাবে ঐতিহ্যবাহী একটি মসজিদ ধ্বংস ও নষ্ট হয়ে যাবে তা মেনে নেওয়া যায় না। আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কর্তৃপক্ষকে জানাবো। যেন এই মসজিদটি বড় ধরনের সংস্কার করা হয়। যেন আরও দর্শনার্থীরা মসজিদটি দেখতে আসেন। আমরা এটি সংস্কার করে আরও দৃষ্টিনন্দন করতে চাই।”