কক্সবাজারে সপ্তাহব্যাপী টানা বর্ষণ, পাহাড় ধস ও পাহাড়ি ঢলে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ২২ জন নারী-পুরুষ ও শিশুর মৃত্যুর পাশাপাশি ধানের বীচতলা, শষ্যক্ষেত, পানবরজ, অর্ধলক্ষাধিক বসতবাড়ি, মৎস্যখামার, চিংড়িঘের ও মজুদকৃত লবণের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
জেলার ৭১ ইউনিয়ন ও ৪টি পৌরসভার মধ্যে ৬১ টি ইউনিয়নে ৫২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ৭৬ হাজার ৫০০ পরিবারের আড়াই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগে পড়ে। জেলা প্রশাসন, উপজেলা পরিষদ এবং ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ক্ষতির পরিমাণ প্রাথমিকভাবে ৪২ কোটি টাকা নিরূপণ করা হয়েছে।
এদিকে বন্যাদুর্গত এলাকায় বসবাসরত মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্যের তীব্র সংকট। মানুষের চাহিদার তুলনায় খাদ্য সহায়তা এবং ত্রাণ তৎপরতা অপ্রতুল বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। আবার অনেকে ত্রান বিতরণে স্বজনপ্রীতির অভিযোগও করেন।
কক্সবাজারে ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে চকরিয়া, মহেশখালী, রামু, কক্সবাজার সদর, টেকনাফ এবং উখিয়ার ৬১ টি ইউনিয়নের আড়াই লাক্ষাধিক মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, বন্যার পানি নেমে গেলেও এসব এলাকায় জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। খাদ্য সংকটে পড়েছে বন্যার্ত মানুষেরা। অর্ধলক্ষাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে। কক্সবাজার জেলার অভ্যন্তরিন সড়ক যোগাযোগ ও বিভিন্ন স্থানে এখনো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে জনদুর্ভোগ বেড়েছে আরো বেশি। একদিকে করোনা মহামারি, অন্যদিকে সর্দিকাশি, জ্বর, ভাইরাস ও ডায়রিয়া বেড়েছে বন্যা দুর্গত এলাকায়। অসহনীয় দুর্ভোগ যন্ত্রণায় অনেকেই খোলা আকাশের নিচে জীবনযাপন করছেন।
জেলার কক্সবাজার পৌরসভাসহ ১৭টি স্থানে নোঙরখানা খোলা হয়েছে। এসব নোঙরখানার তদারকি করছেন জেলা প্রশাসন, উপজেলা পরিষদ, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ইউপি চেয়ারম্যানরা। বিশেষ করে চকরিয়া, রামু, কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, উখিয়া, টেকনাফ ও মহেশখালীর অবস্থা ভয়াবহ।
সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের পাশাপাশি জেলা আওয়ামীলীগ, উপজেলা আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন এনজিও ইতোমধ্যে ত্রাণ তৎপরতা, চিকিৎসা শিবির খুলে অসুস্থদের মোবাইল হাসপাতালের মাধ্যমে চিকিৎসা ব্যবস্থা ও ত্রাণ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কক্সবাজার সদর উপজেলা পিএমখালী ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের মেম্বার নুরুল হুদা বলেন, "বাংলাবাজার নয়াপাড়া,ডিকপাড়া,স্ইুস গেইট এলাকার অন্তত ২ শতাধিক ঘরে পানি উঠেছিল। এখন পানি নেমেছে তবে এখনো খাবার নেই অনেক পরিবারে।"
"এলাকার বেশিরভাগ মানুষ দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষ। ত্রাণ সহায়তা বলতে কিছু শুকনো খাবার পেয়েছিলাম। কিন্তু পাশ্ববর্তী ইউনিয়নে বেশ কয়েক প্রকারের ত্রাণ সহায়তা পেয়েছে মানুষ। এতে জনগন আমাদের দুষছেন।"
এদিকে ঈদগাঁও জালালাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইসরুল হাসান রাসেদ বলেন, "আমার ইউনিয়নের অন্তত ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্ধি। পানি কিছুটা নামলেও এখনো অনেক মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। এছাড়া যোগাযোগব্যবস্থার চরম অবনতি হয়েছে। ফলে মানুষ কাজে কর্মেও যেতে পারছে না। সত্যি কথা বলতে অনেক মানুষ ফোন করলে বলছে খাবার ভাগাভাগি করে খাচ্ছে তারা। আর ত্রাণ সহায়তা বলতে তেমন কিছুই পায়নি। ত্রাণ সহায়তার চেয়ে যোগাযোগব্যবস্থার দ্রুত উন্নতি করাটা এখন বেশি জরুরি।"
চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, "বন্যায় আমাদের ৭/৮ টি ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এতে এলাকার মানুষের মধ্যে খাবার পানিসহ খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি ইতোমধ্যে ৫ হাজার মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছি। সরকারের পক্ষ থেকে যে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে তা খুবই অপ্রতুল।"
"মানুষের এখন সব চেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যাতায়ত ব্যবস্থা। আমার মতে আগে সেদিকে নজর দেওয়া দরকার বলে মনে করছেন চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী।
এদিকে কক্সবাজার -৩ আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল, কক্সবাজার সদর, রামু, ঈদগাও এলাকা পরিদর্শন করে ত্রাণ বিতরণ করেন। কক্সবাজার -১ সংসদীয় আসনের এমপি জাফর আলম চকরিয়া ও পেকুয়ার ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন করে ত্রাণ তৎপরতা ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। কক্সবাজার -২ আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক মহেশখালী উপজেলার বিশেষ করে কালারমারছড়া, হোয়ানক, শাপলাপুর, ছোট মহেশখালী ও বড় মহেশখালীতে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা থেকে দ্রুত ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণের জন্য ইউনিয়ন পরিষদসমুহকে নির্দেশণা দিয়েছেন।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ মামুনুর রশীদ বলেন, "বন্যাকবলিত এসব মানুষের জন্য ৩০০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বরাদ্দ আরও বাড়ানো হবে। সরকারের পাশাপাশি যার যার অবস্থান থেকে বন্যা কবলিত মানুষের পাশে এগিয়ে আসতে হবে।"
বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে স্বাস্থ্য সেবা, রাস্তাঘাট, কৃষি, মৎস্য, লবণ, ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধ সংস্কার করা হবে বলেও জানান তিনি।