১৩৬ কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্প বাতিল হওয়ার খবরে উত্তরবঙ্গের ১৩টি জেলার যাত্রীদের মধ্যে হতাশা নেমেছে। যমুনা নদীর গতিপ্রকৃতি পরিবর্তনের নাব্য সংকটের ফলে ফেরি সার্ভিস বাতিল করার সুপারিশ করেছে তদন্ত টিম। নাব্য সংকট ও বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর ২০০৫ সালের ১৫ জুন থেকে এ রুটে ফেরি সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়।
জানা যায়, ২০১৩ সালের ২৯ মার্চ বিআইডব্লিউটিএর এক সভায় নৌরুটটি আবারও চালু করে ফেরিঘাট নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। ২০১৪ সালের ১২ মার্চ ঘাট ঘুরে দেখেন নৌমন্ত্রী, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী, ডেপুটি স্পিকার, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। তারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতামত নিয়ে ফেরি চালুর বিষয়ে মত দেন। তার আলোকে ডিপিডি প্রস্তুত করা হয়।
২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে একনেক সভায় এই প্রকল্প অনুমোদন হয়। প্রথমে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২৪ কোটি ৭৭ লাখ, ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ ধরা হয়। পরবর্তী সময়ে প্রকল্প দুইবার সংশোধন করে ব্যয় বাড়িয়ে ১৪৫ কোটি ২ লাখ টাকা ধরা হয় এবং ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়।
প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে এসে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য কারিগরি টিম গঠন করে বিআইডব্লিউটিএ। সম্প্রতি এপ্রিল-মে মাসে এসে এই কমিটি সরেজমিনে এই নৌরুটের সম্ভাব্যতা যাচাই করে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে নৌরুটের নাব্যতা সংকট, ২৬ কিলোমিটারের দূরত্বের নৌপথ, একবার পার হতে ৪-৫ ঘণ্টা সময় লাগা এবং নীতিনির্ধারকদের নিরুৎসাহ ও সম্ভাব্যতা সমীক্ষা না করে প্রকল্পের স্থান নিরূপণ করাসহ বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে এই রুট ফেরি চলাচলের উপযোগী নয় বলে মতামত দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া প্রতিবেদনে দুই প্রান্তের ফেরিঘাট অন্যত্র স্থানান্তরসহ নির্মিত স্থাপনা অন্য কাজে লাগানোর সুপারিশ করা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএর কারিগরি কমিটির এই সিদ্ধান্ত সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা ও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। প্রকল্পের ১৩৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা খরচ করে বাস টার্মিনাল, টোল আদায় বুথ, পুলিশ ব্যারাক, ফায়ার সার্ভিস, আনসার ব্যারাকসহ অনেক স্থাপনা নির্মাণ করার পর কারিগরি কমিটি হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত প্রদান করায় বিআইডব্লিউটিএর কাজের ভূমিকা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।
অনেকের অভিযোগ, আগে সম্ভাব্যতা যাচাই না করে কাজ শুরু করে শেষ পর্যায়ে এসে বিভিন্ন সমস্যা তুলে ঐতিহ্যবাহী বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট প্রকল্পটি বাতিল করা ঠিক হয়নি। ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ সরকার দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট ঘাট চালু করে। একসময় এই ঘাটের নামডাক ছিল দেশজুড়ে। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে শেষ বিদ্রোহী নেতা সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নাম অনুসারে বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নের নামকরণ করা হয়। শুরুতে ঘাট বাহাদুরাবাদ ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল আর সেই নাম অনুসারেই পরবর্তীকালে বাহাদুরাবাদ ঘাটের নামকরণ করা হয়।
এরপর থেকে উত্তরবঙ্গের ১৩টি জেলার হাজার হাজার লোক এই ঘাট দিয়ে পার হয়ে ট্রেনে ঢাকাসহ দেশের উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ময়মনসিংহ অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থা রক্ষা করা হতো, তবে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর ২০০৫ সালের ১৫ জুন এই ফেরিঘাটটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এখনো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকা দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নদীপথে চলাচল করছেন। প্রতিকূল পরিবেশে ও আবহাওয়ার কারণে অনেক সময় বহু লোক নৌকা ডুবে প্রাণ হারিয়েছেন। দুই পারেই বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ আছে। এভাবেই চলছে যমুনার দুই পারের লোকজনের যাতায়াত।
বাহাদুরাবাদ ঘাট এলাকার চুকাইবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান রাসেদুজ্জামান সেলিম খান বলেন, ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে তিন ঘণ্টায় নৌকায় পারাপার হচ্ছে মানুষ। তারা নিরুপায় হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলছেন। ফেরিঘাট চালুর খবরে দুই পারের মানুষের মধ্যে আনন্দ দেখা দিলেও সে আশায় গুড়ো বালি ছিটিয়ে দিল তদন্ত কমিটি। হাজার হাজার যাত্রীর কথা বিবেচনা করে ফেরি চালু করার দাবি জানান তিনি।
জামালপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, “বাহাদুরাবাদ বালাসী ফেরিঘাটটি চালু করার জন্য যা কিছু করা দরকার, তা-ই করব। ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে আছেন, তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি সুস্থ হয়ে দেশে এলে দুইজন মিলে উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সোলায়মান হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এ ফেরিঘাট চালু হবে, এটি এই অঞ্চলের মানুষের প্রাণের দাবি ছিল। ফেরিঘাট চালুর স্বপ্নে আশায় বুক বেঁধে ছিল সবাই, এ ঘটনায় আশাহত হয়েছে। নৌরুট পুনরায় চালু করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি করছি।”
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম আব্দুল্লাহ বিন রসিদ বলেন, “এ ফেরিঘাট চালু হলে মানুষের যাতায়াতের অনেক সুবিধা হবে এবং এ অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা আরও সচল হবে। আমি আশা করি কারিগরি কমিটি আবার সমীক্ষা চালিয়ে কীভাবে নৌরুটটি চালু করা যায় সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, আমি সেই প্রত্যাশা করছি।”