পাহাড়ধস ও ঢলে ১ যুগে মৃত্যু ২৭৩


কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রকাশিত: জুলাই ৩০, ২০২১, ০১:৫১ পিএম
পাহাড়ধস ও ঢলে ১ যুগে মৃত্যু ২৭৩

কক্সবাজারের ৯ উপজেলায় ১০ লাখের বেশি মানুষ সরকারি বনভূমি পাহাড়ের পাদদেশে বা পাহাড়ের চূড়ায় ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছেন। ২০১০-২১ সালের ২৯ জুলাই পর্যন্ত পাহাড় ধসে বা ঢলে ডুবে কক্সবাজার জেলায় ২৭৩ জন নারী-পুরুষ ও শিশুর মৃত্যু হয়েছে।  

বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড় কাটা ও বন উজাড় করার ফলে এ ধরনের প্রাণহানির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এর মধ্যে মহেশখালীতে ২৯ জন, চকরিয়ায় ৩৭ জন, কক্সবাজার সদরে ৯৮ জন, উখিয়ায় ২৭ জন, টেকনাফে ৪২, রামুতে ২৩ জন ও ঈদগাঁও উপজেলায় ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

মহেশখালী

কালারমারছড়া, হোয়ানক, শাপলাপুর ও ছোট মহেশখালীতে গত ১২ বছরে ২১ দফা পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। এতে ২৯ জন নিহত হলেও আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। 

কক্সবাজার সদর

পাহাড়তলী, কলাতলী, ঘোনারপাড়া, বৈদ্যঘোনা, টিঅ্যান্ডটি পাহাড় এলাকা, সার্কিট হাউস এলাকা, পাতের বাপের ঘোনা, মহাজেরপাড়া, বাদশাঘোনা, খাজা মঞ্জিল ও লারপাড়া ইসলামাবাদ এলাকা এবং সদর উপজেলার পাশ্ববর্তী দক্ষিণ হাজীপাড়া, লিংকরোড়ের দক্ষিণ মহুরিপাড়াসহ ইত্যাদি এলাকায় অসংখ্যবার পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। এতে হতাহত হয়েছে দুই শতাধিক। 

টেকনাফ

হোয়াক্ষ্যং, বাহারছড়া, হ্নীলা ও টেকনাফ সদরের নাইটংপাড়া, নয়াপাড়া, কেরুনতলী, রঙিখালী, পানখালী ভিলিজারপাড়া, জাদিমুড়া ও রোহিঙ্গা শিবিরে প্রতিবছর পাহাড়ধসের ঘটনা সংঘটিত হয়। এতে গত ১২ বছরে শতাধিক লোক হতাহত হয়েছেন।

উখিয়া

পালংখালী, রাজাপালং, রত্নাপালং, হলদিয়াপালং, জালিয়াপালং, কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী ও রোহিঙ্গা শিবিরে গত ১২ বছরে অন্তত ২০ বার পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এতে ২৭ জন নিহতসহ আহত হয়েছেন শতাধিক। 

রামু 

খুনিয়াপালং, রাজারকুল, দক্ষিণ মিঠাছড়ি, কাউয়ারখুপ, উত্তর মিঠাছড়ি, জোয়ারিয়ানালা, ঈদগড়, কচ্ছপিয়া, গর্জনিয়া ও রশিদনগরে গেল ১২ বছরে অসংখ্যবার পাহাড় ধস হয়েছে। এতে হতাহত হয়েছেন শতাধিক লোক। 

চকরিয়া 

খুটাখালী, ডুলাহাজারা, ফাঁসিয়াখালী, কাকারা, বরইতলী ও হারবাং ইউনিয়নে এক যুগে ৪৫টি স্থানে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। এতে হতাহত হয়েছেন দেড় শতাধিক মানুষ। 

ঈদগাঁও

ঈদগাঁও সদর ইউনিয়ন, ইসলামাবাদ ও ইসলামপুর ইউনিয়নে প্রতিবছর কোনো না কোনো এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এতে গত ১২ বছরে অর্ধশতাধিক মানুষ হতাহত হয়েছেন। 

মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহফুজুর রহমান জানিয়েছেন, মহেশখালীতে ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি লোক পাহাড়ি বনভূমি দখল করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন। 

চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, ১৯৯১ ও ১৯৮৭ বন্যা এবং ১৯৯৭ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার পর চকরিয়ার নিম্নাঞ্চল, পেকুয়া উপকূলীয় অঞ্চলের লোকজন এবং মহেশখালী, কুতুবদিয়ার গৃহহীন উদ্বাস্তু লোক চকরিয়ার উঁচু এলাকা বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চল দখল করে বসবাস করছেন দীর্ঘদিন ধরে। ফলে বনভূমি, বনবিভাগীয় বন কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। এ কারণে বাঁচার তাগিদে লাখ লাখ মানুষ পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছে। 

এদিকে কক্সবাজার শহরের অবস্থা আরও ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান। পৌর মেয়র জানান, শহরের ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে লক্ষাধিক লোক পাহাড়ের পাদদেশে এবং চূড়ায় বসতবাড়ি নির্মাণ করে বাস করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এতে দেড় লক্ষাধিক মানুষের জানমালের নিরাপত্তা আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে।

রামু উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজল জানান, রামুর হিমছড়ি, খুনিয়াপালং, রাজাপালং, দক্ষিণ মিঠাছড়ি, গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, কাউয়ারখুপ, মনিরজিল, জোয়ারিয়ানালা ও রশিদনগরে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার লোক পাহাড়ি বনভূমি জবরদখল করে বসবাস করছেন। 

উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, উখিয়াতে রোহিঙ্গাসহ ১০ লক্ষাধিক লোক পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছেন। 

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, তার ইউনিয়নে লোকসংখ্যা রয়েছে ৫৫ হাজার এর মধ্যে ২০ হাজর মানুষ পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করছেন। অন্যদিকে শুধু পালংখালী ইউনিয়নেই পাহাড়ে রোহিঙ্গা বসবাস করছে আট লাখেরও বেশি। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় এসব রোহিঙ্গা বসবাস করছে।

এদিকে টেকনাফ ও ঈদগাঁর অবস্থা আরও ভয়াবহ বলে জানান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী।

জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে কক্সবাজার পৌরসভার ১২টি, উখিয়া-টেকনাফ, মহেশখালী, চকরিয়া, ঈদগাঁ ও রামুর ৮০টির বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। 

জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ জানিয়েছেন, ভারী বর্ষণ, ভূমিধস ও পাহাড়ি ঢলের ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে লোকজনকে পাহাড় থেকে  নিয়ে আসার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসন নিয়মিত মাইকিং করে যাচ্ছেন এবং লক্ষাধিক লোককে পাহাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। 

২০১৯ সালের জুন মাসে ভারী বর্ষণের ফলে অন্তত ৮৭ জন মানুষ কক্সবাজার পৌরসভা ও বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড় চাপা মারা গিয়েছিল। মেরিন ড্রাইভ সড়কে হিমছড়িতে পাহাড় ধসের ঘটনায় ১০ নিহত হন। শুধু তাই নয় সেনাবাহিনীর ১৬ ইসিবির প্রকৌশল বিভাগের কর্মীরা মাটি সরিয়ে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করেছিল।

গত ১ যুগের হিসাবে এ সংখ্যা ২৭৩ জনের মৃত্যু ঘটেছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন সূত্র। 

এদিকে পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, অব্যাহত পাহাড়কাটা, বন উজাড় এবং বনভূমিতে বিনা অনুমতিতে বহুতল ভবন বা স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত থাকায় পাহাড় ধসের মতো মারাত্মক দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। এটি প্রকৃতির নিষ্ঠুর প্রতিশোধ বলে মনে করেন বাপার এ নেতা। 

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ জানান, শ্রাবণের অতি বর্ষণে গত চারদিন ধরে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। পাহাড়ি ঢলে বসতবাড়ি ও জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, পাহাড়ধস ও বন্যার ফলে কক্সবাজারে অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। জেলাজুড়ে টানা বর্ষণ অব্যাহত থাকায় বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়ে গত ৪৮ ঘণ্টায় নারী ও শিশুসহ ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জন রোহিঙ্গা। 

Link copied!