জীবনানন্দ দাশের পরে একমাত্র মিলান কুন্দেরাই বলেছিলেন, কোথাও জীবন আছে, জীবনের স্বাদ রহিয়াছে। জানিয়েছিলেন অমরত্বের সূত্রসন্ধান। আমরা সেই নতুন জীবনের সুলুকসন্ধান জানতে উঁকি মেরেছি তাঁর শব্দজগতে। কিন্তু, হায়, সেই তো রক্তেপূঁজে গেঁথে-যাওয়া মাছিকেই দেখেছি, অসহায়, অন্যনির্ভর, রাজনীতি ও সমাজ, ব্যক্তিসম্পর্ক ও সমস্যার জালে জড়িয়ে বিব্রত এক তেলাপোকা হয়ে যেতে।
কুন্দেরা টেনশন পছন্দ করতেন, তাঁর চরিত্রদের জড়িয়ে রাখতেন যৌন, রাজনৈতিক, ও ব্যক্তিজগতের নানাবিধ টেনশনে। টানটান করে রাখতে রাখতেই তিনি সুতো বুনতেন দার্শনিকতার, রাজনীতির, ও অসহনীয় বাস্তবতার। তাঁর টমাস যেন কাম্যুর আউটসাইডার। এমনকি ঠিক ঠিক এই শব্দটিই তাঁর দ্য আনবিয়ারেইবল লাইটনেস অব দ্য বিয়িংয়ে উঠে এসেছে একাধিকবার। তবে কাম্যুর ম্যেরস্যয়ের মত তাঁর টমাস অতটা নিস্পৃহ নয়, বরং তার নিজস্ব যৌনতা ও বোঝাপড়া নিয়ে সে কিছুটা ব্যাকুলই। কিন্তু অন্তে সে শীতল সিসিফাস। ওই উপন্যাসে তিনি ভারী ও হাল্কার দ্বিত্ব প্রসঙ্গে হেগেল টানেননি, এনেছেন পারমেনদেস নামের গ্রিক দার্শনিককে।
অথচ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তাঁর বাস্তবতার অদ্ভুত একটি উপকরণ ঘুরে ফিরে লেইতমোতিফের মত বারবার এসেছে তাঁর লেখায়, সূক্ষ্ম ও স্থূলভাবে। সেটি রসিকতা। সেটি কখনো রাজনৈতিক রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যঙ্গ ও তুচ্ছ করতে, কখনোসখনো রাষ্ট্রের করালগ্রাস স্পষ্ট করতে, কখনো রাষ্ট্রের দোর্দণ্ডপ্রতাপ স্পষ্ট করতে। সামগ্রিকভাবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি তাঁর আমর্ম ঘৃণার কারণ খোলাখুলিই তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর সর্বাধিক পঠিত উপন্যাস দ্য আনবিয়ারেইবল লাইটনেস অব দ্য বিয়িংয়ে, যেখানে চেকবাসীদের ওপর সোভিয়েত রাশ্যার দখল, নিপীড়ন, ও আত্মাধ্বংসী আচরণের, পাশাপাশি বাকস্বাধীনতা হরণ; বিকট নজরদারি, দৃশ্য ও শ্রাব্য গুপ্তপ্রযুক্তি ব্যবহারে; এবং স্বাধীনতা উন্মূলের প্রভূত প্রমাণ তিনি উপন্যাসের প্রতি পরিচ্ছেদে ছড়িয়ে রেখেছেন। রেখেছেন ঠাট্টা নামের উপন্যাস এবং দ্য লাফেবল লভজ নামের গল্পগ্রন্থেও। স্রেফ একটি মশকরা যে রক্তচক্ষু, বরফশীতল আত্মার রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষ থেকে ব্যক্তিমানুষকে কতটা নির্যাতন ও নির্বাসন উপহার দিতে পারে সেটি পড়তে পড়তে আমাদের হাতপা শীতল হয়ে আসে, যদিও প্রায় সমান বাস্তবতায় আমরা এখনো ফেসবুকে নানাবিধ রসিকতা করে বাস্তবতা সহনীয় করার ভিন্নতর ডিফেন্স মেকানিজমে বিশ্বাসী। কুন্দেরা রসিকতা ব্যবহার করেন রাষ্ট্রকে মুখ ভ্যাংচাতে, ব্যক্তির ভঙ্গুর দশা প্রদর্শনে, কিংবা নিজের ডার্ক কমেডির হাতসাফাইয়ে।
মনে করার কোনো কারণ নেই যে কুন্দেরা শুধু কম্যুনিজম ব্যবস্থা বা কম্যুনিস্টদেরই একহাত নিয়েছেন। মার্কিনি জীবনযাত্রার ফাঁপা আত্মারিক্ততাও তিনি ভালো করে দেখে নিয়েছেন উল্টেপাল্টে। তাই, তাঁর সোনিয়া চরিত্রটা দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িংয়ে একজন মার্কিনি সিনেটরের পিঠচাপড়ানো হাসির সাথে কম্যুনিস্ট শাসকের তৃপ্তির হাসির চরম সমান্তরলতা খুঁজে পায়। এবং ভিয়েতনামের দখলে অতিষ্ঠ কম্বোডিয়াবাসীদের সহায়তার জন্যে গ্র্যান্ডমার্চে একজন অনামী মার্কিনি অভিনেত্রীর শোঅফের ন্যাকামো তিনি ইচ্ছে করেই প্রকট করেন সেটার ন্যাংটো কদর্যতা তুলে ধরতে।
সম্পূর্ণভাবে ইউরোপের সন্তান ছিলেন তিনি, না, সেটার মান্যতা দিতে গিয়ে চেকোশ্লোভাকিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের বা নেটোর সদস্য হয়েছে বলে নয়, তাঁর মর্ম, মজ্জা, ও মগজে তিনি ছিলেন আধুনিকতার সন্তান ও স্রষ্টা। তাঁর লেখায় উত্তরাধুনিকতা মিলবে না, মিলবে না ঔক প্রজন্মের হাতফেরতা এলজিবিটিকিউ চিহ্ন বা বর্ণবাদের উল্কি। তিনি ঘৃণা জন্ম দিতে পারেন শুধু টোট্যালিটারিয়ান শাসন ও দখলদারি ভূমির রাজাকারদের প্রতি। বাকি ব্যাপারে তিনি একান্তই ব্যক্তির মনোভূমির অন্তর্গত, যেখানে প্রেম মানেই হেটেরোসেক্সুয়ালিটি। কিন্তু সেসবের ঐশ্বর্যও নেহাত কম নয় বলে তাঁর হাতে শেষবার চুমু খেয়ে কফিনের ডালাটি নামিয়ে দিয়ে আমরা ফিরে আসব তাঁর প্রিয় একজন সুরকার বেটোফেনের রিকুয়েমের পিয়ানোয়।
কুন্দেরা ৯৪ বছর বেঁচে থেকে যে নোবেল না-পেয়েও চলে গেলেন, প্রতি বছর উৎসুক সাহিত্যপ্রেমীদের সতৃষ্ণ কাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও, এটা হয়তো সোভিয়েতের বর্তমান অকার্যকারিতাই স্পষ্ট করে। হয়তো শীতল যুদ্ধ এখনো চললে রাজনৈতিক পাল্টাপাল্টিটা প্রাসঙ্গিক থাকতে থাকতে তিনিও কিছুটা প্রাসঙ্গিক থাকতেন। সত্তুরের দশকের পর তাঁর খুব বেশি কিছু সৃষ্টি লোকজনকে নাড়া দেয়নি। কিন্তু সাহিত্যের প্রস্তরফলকে কুন্দেরা অক্ষয় নাম হয়ে থেকেই গেছেন, নোবেল কমিটির রাজনীতিসচেতনতা ঝাড়ু মেরে।
হয়তো, এই দীর্ঘজীবনও তাঁর কৌতুকেরই ফল, সকৌতুকে তিনি নোবেল কমিটির বিব্রতদশা উপভোগ করছিলেন যারা তাঁকে তাঁদের খুদে তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে অনেক আগেই, ভুলেই গেছে যে সর্বকালের সেরা সাহিত্যিকদের স্বর্ণতালিকায় তাঁর নাম খচিত হয়ে রয়েছে আরও অনেক গ্র্যান্ডমাস্টারদের সঙ্গে।
                
              
																                  
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    






































