হাজতখানার নাম শুনলে অনেকেই ময়লা, দুর্গন্ধ আর বদ্ধ ঘরের চিত্রের কথা বলেন। তবে ঢাকা রেলওয়ে থানার হাজতখানা এই ধারণা পুরোপুরি পাল্টে দেবে। আধুনিক নির্মাণশৈলী, পরিষ্কার টয়লেট, বসার জায়গা আর পাশেই একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি নিয়ে ঢাকা জেলা রেলওয়ে পুলিশের হাজতখানা।
স্টেশনের ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পানি আর ছোটদের জন্য চকলেটের ব্যবস্থা করেছে রেলওয়ে পুলিশ। এসব সেবা পেয়ে খুশি স্টেশনে চলাচলকারীরা।
সেবাগ্রহীতারা জানান, এটা একটা ভালো উদ্যোগ। দেখা যায়, যাত্রীরা অনেক দূর থেকে আসে এই প্ল্যাটফর্মে। আর তখন পানির তৃষ্ণা পেলে তা মেটাতে পারে। এ রকম ব্যবস্থা খুব কম জায়গাতে দেখা যায়। এমন কাজের মাধ্যমে পুলিশের প্রতি মানুষের নেতিবাচক মনোভাব দূর হবে এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে পুলিশের ভালো সম্পর্ক তৈরি হবে।
দায়িত্বরত পুলিশ কনস্টেবল সুবর্ণা রহমান জানান, শীতে দৈনিক ৩-৪টি পানির জার লাগে এবং গরমের দিনে একটু বেশি লাগে। আর দিনে ৩ প্যাকেট চকলেট লাগে এই প্ল্যাটফর্মটিতে।
হাজতখানার চিত্র
হাজতখানায় ঢুকতে দেয়ালের ওপর চোখ পড়বে সবার। পুলিশের সেবা কবিতার লাইন হয়ে স্বাগত জানাবে এখানে। অর্থাৎ থানার প্রবেশমুখে দেয়ালে সাঁটানো পোস্টারে লেখা রয়েছে ‘পুলিশের চাকরিতে এমনটাই শান্তি, মানুষের সেবায় যেন না আসে ক্লান্তি।’
ডিউটি অফিসারের টেবিলের উল্টো দিকে বুকশেলফ, আছে হরেক রকম বই। সেবা নিতে এসে বই দেখে মন ভালো না হওয়ার উপায় আছে! কক্ষটির দক্ষিণ কোণে বানানো হয়েছে নারী ও শিশু হেলপডেস্ক। প্রতিদিন কমবেশি নারী ও শিশুরা এই ডেস্ক থেকে নানা সাহায্য পেয়ে থাকেন। কমলাপুর স্টেশনে আসা ও হারিয়ে যাওয়া শিশুদের খোঁজ পেতে জিডি করতে আসা ব্যক্তিদের সহায়তায় নিয়োজিত থাকেন পুলিশের একজন নারী সদস্য।
এবার হাজতখানার গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে দেয়ালে ঝুলছে একটি বইয়ের তাক। দৃষ্টিনন্দন শেলফে থরে থরে সাজানো বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী, রকমারি কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি ও ধর্মীয় বই।
বইয়ের তাকের ওপরের দেয়ালে হঠাৎ চোখ আটকে গেল। সেখানে লেখা, ‘অপরাধের সূত্রপাত এই দুটি হাত/ মানবো না এই অজুহাত/ শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বিশ্বস্ত অস্ত্র হস্ত/ জগতে মহৎ কর্মে রাখিব ব্যস্ত’ এবং ‘ক্ষমাও এক প্রকার শাস্তি। ক্ষমার মহত্ত্ব বুঝতে ব্যর্থ ব্যক্তিরা ক্ষমার অযোগ্য, ক্ষমা একজন মহৎ ব্যক্তিই করতে পারেন।’
কক্ষটিতে দুই পাশে দুটি বেঞ্চ, মাঝে একটি টেবিল, পাশের দেয়ালের তাকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের বইপত্র। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা কারাগারের রোজনামচা, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, মনিরুল ইসলামের পীড়নে পীড়িত জীবন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কাঁদো নদী কাঁদো, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথাসহ ধর্মীয় নীতিমূলক বেশ কিছু বই দেখতে পাওয়া যায়।
দেয়ালের পাশে ডাইনিং। মাথার ওপরে ঝুলছে ফ্যান। আর এত সব আয়োজন বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা অপরাধীদের জন্য। হাজতখানার মেঝেতে বসানো হয়েছে মার্বেল পাথর। রয়েছে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থাও। আছে নামাজ পড়ার জায়গা। শোয়া ও পড়াশোনার ব্যবস্থা তো আছেই।
কমলাপুর রেলওয়ে থানার ভেতরে এমনই নান্দনিক দৃশ্য সবাইকে আপ্লুত করবে। হাজতখানাসহ থানার প্রতিটি কক্ষে কয়েকটি বইয়ের শেলফ দেখে মনে হতে পারে এটি কোনো পাঠাগার। দেশের বিভিন্ন এলাকার থানার ভেতরের পরিবেশ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে রয়েছে নেতিবাচক ধারণা।
থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শাহজাহান বলেন, “ঢাকা রেলওয়ে জেলা পুলিশ সুপার নিজ উদ্যোগে যাত্রীসাধারণের কল্যাণময় কাজের জন্য সব সময় সচেষ্ট থাকেন। তেমনি আসামিরাও যেন বুঝতে পারেন পুলিশ কোনো আতঙ্কজনক ব্যক্তি বা সংস্থা নয়। হাজতখানায় নেওয়া অপরাধীদের চিন্তাভাবনার পরিবর্তন ঘটাতেই এমন আয়োজন।”
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ঢাকা রেলওয়ে থানায় বর্তমানে চার থেকে পাঁচজন বন্দি সহজেই থাকতে পারেন। খুব বড় ধরনের মামলার আসামিদের এই হাজতখানায় রাখা হয় না। রেলওয়েতে ঘটে যাওয়া ছোটখাটো অপরাধে হওয়া মামলার আসামিদের এখানে রাখা হয় এবং এক দিনের বেশি রাখা হয় না বলে জানা যায়।
ঢাকা রেলওয়ে জেলা পুলিশের এসপি সাইফুল্লাহ আল মামুন বলেন, “যারা বিভিন্ন অভিযোগে কম সময়ের জন্য হাজতে আসেন, আমার কাছে মনে হয়েছে এই সময়টাতে তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কিংবা হতাশাগ্রস্ত সময় অতিক্রম করেন। এই সময়ে যদি ছোট্ট লাইব্রেরি করে তাদের একটা বই দিতে পারি বা একটা সুন্দর পরিবেশ দিতে পারি, লাইব্রেরির পাশাপাশি বইয়ের সঙ্গে মানসিক বিকাশ, মানসিক চিন্তা সম্পৃক্ত সে রকম একটা ধারণা থেকেই লাইব্রেরির পাশাপাশি পরিবেশটাকে উন্নত করা হয়েছে। একদিন দেখলাম এক হাজতি সে নিজের থেকেই বড় পড়ছে। এ দৃশ্যটাই তখন আমাকে অন্যভাবে ভাবতে শেখাল যে, আমরা একটা লাইব্রেরি করলে এখানে ভালো হয়। আর যখন লাইব্রেরি করতে গেলাম তখন বললাম আনুষঙ্গিক যে পরিবেশ আছে সেটাকে আরও সুন্দর করলে ভালো হয়। অন্যদিকে দেখলাম, এখান দিয়ে যে যাত্রীগুলো আসা-যাওয়া করে তারা পানি পায় না। তাই একটু পানির ব্যবস্থা করা হলো। আর ছোট্ট বাচ্চাদের ভ্রমণটাকে আনন্দ এবং সুখকর স্মৃতিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে চকলেটের ব্যবস্থা করা হয়।”
এসপি সাইফুল্লাহ আল মামুন আরও বলেন, “ইতিমধ্যে আরও চারটি থানায় এমন কার্যক্রম শুরু হওয়ার কাজ প্রক্রিয়াধীন। একটা অবাক করার বিষয় হলো, আমরা অনেক হাজতিকে বই পড়তে দেখেছি। এটা আমাদের চেষ্টার একটা ভালো দিক।”