ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ বলেছেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ভারত সবসময় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। বন্ধুত্বের পূর্ণ সম্ভাবনা বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য যথাসাধ্য করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
বৃহস্পতিবার (১৬ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউয়ে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং মহান বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর আলোচনা অনুষ্ঠানে ঢাকায় সফররত দেশটির রাষ্ট্রপতি এসব কথা বলেন।
এছাড়া বাংলায় বাংলাদেশের মানুষকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানিয়ে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শুরুতে রামনাথ কোবিন্দ বলেন, “নমস্কার, শুভসন্ধ্যা, আসসালামু আলাইকুম। আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই।”
এদিকে বিশেষ অতিথির বক্তব্যের শুরুতে রামনাথ কোবিন্দ বাংলায় বাংলাদেশের মানুষকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান। বক্তব্যের মাঝামাঝি তিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার কয়েক চরণ আবৃত্তি করেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের আবৃত্তি করা লাইনগুলো হলো-
‘মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না-
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
ভারতের রাষ্ট্রপতি বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি ধারাবাহিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, দু’দেশের মানুষে-মানুষে সম্পর্ক, ছাত্র বিনিময় এবং সহযোগিতার একাধিক ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মকাণ্ড। এসব আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সার্বভৌম সমতা এবং নিজ নিজ দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে রচিত টেকসই ও গভীর বন্ধুত্বের নিশ্চয়তা। আমাদের প্রচেষ্টাগুলো এই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা আরও অনুপ্রাণিত হয়েছে।”
রামনাথ কোবিন্দ বলেন, “গত এক দশকে বাংলাদেশের প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করেছি। যা বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা বাস্তবায়নের সুযোগও তৈরি করেছে। ভৌগোলিক সুবিধা ও বাংলাদেশের চমৎকার অর্থনৈতিক সাফল্য সমগ্র উপ-অঞ্চল এবং বিশ্বকে উপকৃত করতে পারে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একটি ক্রমবর্ধমান ধারণা রয়েছে যে, ঘনিষ্ঠ উপ-আঞ্চলিক বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সংযোগ স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সোনার বাংলা গঠনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করবে।”
এ সময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত বাংলাদেশিদের উদ্দেশে ভারতের রাষ্ট্রপতি বলেন, “বাংলাদেশ বিস্ময়কর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, উর্বর জমি সমৃদ্ধ এবং নদীবিধৌত অনন্য দেশ। এটি কবি, শিল্পী, পণ্ডিত ও চিন্তাবিদদের দেশ। ঐতিহাসিকভাবে এ ভূখণ্ডের মানুষ সবসময় শিল্প ও পাণ্ডিত্যকে গভীরভাবে মূল্যায়ন করেছে। আপনারা সর্বদা আপনাদের জাতীয় পরিচয়ের প্রভাবশালী এবং ঐক্যবদ্ধ উপাদান-মন, সংস্কৃতি এবং ভাষার সাধনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ফলস্বরূপ, আপনাদের মধ্যেই একটি সুসংগত, সম্প্রীতিপূর্ণ এবং গতিশীল সমাজের অনন্য মেলবন্ধন রয়েছে।”
রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ বলেন, “দুই দেশের অংশীদারিত্বের প্রথম ৫০ বছর অসাধারণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শুরু হয়। এতে জনগণের মধ্যে একটি গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়। সম্ভবত বন্ধুত্বের এ সীমাকে বাড়ানোর সময় এসেছে। এটি অর্জনের জন্য আমাদের ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ এবং বিশেষ করে আমােদের বাণিজ্য এবং প্রযুক্তির জগতে যৌথভাবে বিশ্বব্যাপী অগ্রগামী উদ্যোগ তৈরিতে অনুপ্রাণিত করতে হবে।”
উভয় দেশের উদ্ভাবকদের সাধারণ উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করার জন্য স্থানীয়ভাবে উপযুক্ত প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে নতুন সমাধান খুঁজে বের করার কথা জানিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি বলেন, “আমাদের আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক সেরা ধারণাগুলো খুঁজে বের করতে চিন্তাবিদদের নিজস্ব অনন্য সাফল্যের শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। আন্তঃসংযোগের একটি নতুন যুগে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ধারণা এবং উদ্ভাবনের নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহের সুযোগ তৈরি করতে পারি।”
রামনাথ কোবিন্দ আরও বলেন, “আমাদের উপ-অঞ্চলকে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম উৎপাদন কেন্দ্র এবং পণ্য ও পরিসেবাগুলোর জন্য বিশ্বের বৃহত্তম বাজার হতে সক্ষম করবে। দুই দেশের উন্নয়ন, বন্ধুত্ব আরও গভীরে নিয়ে যাওয়া এবং জনগণের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য একসঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে হবে।”
স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন লাখ লাখ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল জানিয়ে রাষ্ট্রপতি রামনাথ বলেন, “তখন সমালোচক, সন্দেহবাদী এবং নিন্দাকারীদের কাছে এটি একটি দূরবর্তী এবং অসম্ভব স্বপ্ন বলে মনে হয়েছিল। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট এবং বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যেন মুক্তির সম্ভাবনাকে বাতিল বলে মনে হচ্ছিল। একটি নিষ্ঠুর, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং সুসজ্জিত শত্রু, যারা কোনো কিছুতেই থামবে না, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বাংলাদেশের প্রতিকূলতা ছিল অনেক বেশি। বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণামূলক নেতৃত্ব, সুস্পষ্ট নৈতিক দৃঢ় প্রত্যয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি ন্যায়বিচারের জন্য তার অদম্য দৃঢ়তা ছিল সত্যিকার অর্থে পট পরিবর্তনকারী। ফলস্বরূপ বিশ্ব একটি মূল্যবান শিক্ষা পেয়েছে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইচ্ছাকে কোনো শক্তি দ্বারা দমন করা যায় না, তা যতই নৃশংস হোক না কেন।”
ভারতের রাষ্ট্রপতি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল এমন একটি বাংলাদেশ যা শুধু রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন নয়, বরং একটি ন্যায়সংগত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রও বটে। দুঃখের বিষয়, জীবদ্দশায় তার দর্শন বাস্তবায়িত হতে পারেনি। স্বাধীনতাবিরোধী যারা বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, তারা বুঝতে পারেনি যে, বুলেট এবং সহিংসতা এমন একটি ধারণাকে নির্বাপিত করতে পারে না। যা মানুষের কল্পনাকে ধারণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় প্রত্যয় এবং তার বিদ্রোহী চেতনার দ্বারা চালিত হয়েছেন।”
ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, “লাখো মানুষের মতো আমিও তার বজ্রকণ্ঠে এবং সেই সময়ে বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষা বহনকারী উপলব্ধিতে বিদ্যুতায়িত হয়েছিলাম। আমার প্রজন্মের লাখ লাখ ভারতীয়ের মতো, আমরা একটি অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ে উল্লসিত হয়েছিলাম এবং বাংলাদেশের জনগণের বিশ্বাস ও সাহসে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম।”