• ঢাকা
  • সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬
চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি

প্রতিশ্রুতির তিন বছরেও মেলেনি ক্ষতিপূরণ


জাহিদ রাকিব
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২২, ০৯:২৪ এএম
প্রতিশ্রুতির তিন বছরেও মেলেনি ক্ষতিপূরণ

পাঁচ সদস্যের পরিবারের বড় ছেলে আহসান উল্লাহ (৩০)। রাজধানীর চকবাজারের একটি কসমেটিকস দোকানে সাত হাজার টাকা বেতনে কাজ করেন। চকবাজারের একটি মেসে দেড় হাজার টাকা ভাড়ায় চারজনের ছোট রুমে থাকেন তিনি। অল্প কিছু টাকা ও খাওয়ার খরচ রেখে বাকিটা গ্রামে অসুস্থ মায়ের ওষুধ, ছোট দুই ভাই ও এক বোনের পড়ালেখার খরচের জন্য পাঠাতে হয় তাকে। সামান্য এই টাকায় পরিবারকে সামলে নিতে হয় আহসান উল্লাহকে। এমন পরিস্থিতিতে পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হয় প্রতিদিন। মাস শেষে তবু সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন একদিন সুদিন আসবে তার ও পরিবারের। আহসান উল্লাহর পরিবারের এমন চিত্র ছিল না আগে। তার বাবা মো. ছিদ্দিক উল্লাহর (৬০) পুরান ঢাকার চকবাজারে সুরুজ গোডাউন ছিল। তিন ছেলে এক মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে ভালোই চলছে ছিদ্দিক উল্লাহর পরিবার। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎ রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মর্মান্তিক মৃত্যুতে আহসান উল্লাহ পরিবারের ওপর নেমে আসে কালো ছায়া। ছিদ্দিক উল্লাহর মতো এ রকম মর্মান্তিক মৃত্যু হয় ৭১ জনের।

চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দুর্ঘটনার তিন বছর আজ। অগ্নিকাণ্ডে পোড়া বাড়ি ওয়াহেদ ম্যানশন সংস্কারে ফিরেছে নতুন রূপ। ভাড়া হয়েছে ভবনের নিচতলার ১০টি দোকান। দ্বিতীয় তলায় ভাড়া নিয়েছে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক। আশপাশের ক্ষতিগ্রস্ত দোকানগুলোর সবাই নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু দুর্ঘটনায় নিহত ৭১ পরিবারের মধ্যে কমসংখ্যক লোক আর্থিক সহায়তা পেলেও বেশির ভাগ মানুষ এখনো সহায়তা পায়নি।

dhaka
ওয়াহেদ ম্যানশন সংস্কারে ফিরেছে নতুন রূপ। ছবি : সংবাদ প্রকাশ 

ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডে নিহত পরিবারগুলোর দাবি, অগ্নিকাণ্ডে নিহত ব্যক্তিদের যোগ্য স্বজনকে চাকরি ও পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য একটি তহবিল গঠন করা কথা বলেছিলেন তিনি। সবার সহযোগিতায় এই তহবিল থেকে আহত ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে অর্থ সহায়তা দেওয়া হবে।

স্বজন হারানো ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের অভিযোগ, ডিএসসিসি সেই সময়কার মেয়রের এমন সিদ্ধান্তের তিন বছর পার হয়ে গেলেও নামমাত্র কয়েকজন সাহায্য পেয়েছেন। তবে বেশির ভাগ মানুষই পাননি সহায়তা। 

স্বজনরা জানান, হাতে গোনা ২৫ থেকে ৩০ জন্য সাহায্য পেলেও এখন চল্লিশের অধিক পরিবার দাফন খরচ বাদে সরকারি কোনো সাহায্য পাননি। সাহায্য না পাওয়ায় আহসান উল্লাহর মতো অনেক পরিবার উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।

প্রতিশ্রুতি দিয়েও সাহায্য না পাওয়া স্বজনদের অভিযোগ

আহসান উল্লাহ সংবাদ প্রকাশকে জানান, তার বাবা ছিদ্দিক উল্লাহর চকবাজারে একটি গোডাউন ছিল। গোডাউন ভাড়া দিয়ে সাত সদস্যর পরিবারের ভালোই চলত। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের রাতে ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলেন তার বাবা। চা খাওয়ার মুহূর্তে হঠাৎ বিস্ফোরণে তার পরিবারের সবকিছু ওলট-পালট হয়ে যায়। বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের দায়িত্ব চলে আসে আহসানের কাঁধে।

আহসান উল্লাহ আরও অভিযোগ করেন, “দুর্ঘটনার পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র নিহত ব্যক্তিদের যোগ্য স্বজনকে চাকরি ও পুনর্বাসনের করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পাশাপাশি দুর্যোগ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার। কিন্তু তিন বছরে একাধিকবার ক্ষতিপূরণের আশায় কাগজপত্র বিভিন্ন জায়গায় জমা দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো ক্ষতিপূরণ পাইনি আমরা।”

দুই সন্তানের জনক মো. জুম্মান (৫০) চকবাজার টাইগার গুঁড়া মসলার ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। তার একার আয়ে চলত স্ত্রীসহ দুই ছেলের খরচ। থাকতেন চকবাজারের একটি ভাড়া বাসায়। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে পুরো পরিবারের।

জুম্মানের বড় ছেলে মো. রাশেদ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, দুর্ঘটনার তিন বছর হয়ে গেছে। আজ পর্যন্ত কেউ এক টাকা দিয়ে সাহায্য করে নানি। উল্টো বিভিন্ন সময় সাহায্য দেওয়ার কথা বল কাগজপত্র জমা দেওয়ার নামে হয়রানির শিকার হন তারা।

রাশেদ আরও বলেন, তখনকার মেয়র সাঈদ খোকন আশ্বাস দিয়েছিলেন, ১৪ দিনের ভেতর ডিএসসিসি থেকে নিহত পরিবারের স্বজনদের জন্য যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি ও অন্যদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে। কিন্তু ১৪ দিন থেকে আজ ৩৬ মাস হয়ে গেছে, এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা পাননি তারা।

অগ্নিকাণ্ডের তিন বছরেও কোনো সহায়তা পাননি ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচে থাকা আল্লাহর দান স্টোরের কর্মচারী চাঁদপুর জেলার মো. হেলাল হোসেনের (৩০) পরিবার। নিহতের বড় ভাই মো. বেলাল হোসেন সংবাদ প্রকাশের কাছে অভিযোগ করে বলেন, “আমরা এখন পর্যন্ত কোনো সাহায্য পাই নাই। অনেকে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু পরে আর কেউ কোনো খোঁজ রাখে নাই।”

বেলাল হোসেনের মতো আব্দুল কাদেরের ভাতিজা ছিদ্দিক রহমানের (২৬) মৃত্যুর তিন বছরেও কোনো সহযোগিতা পাননি বলে জানায় পরিবার। ওয়াহেদ ম্যানশনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের নিহতের অনেকেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সহযোগিতা না পাওয়ার তালিকা দীর্ঘ বলে জানান নিহত পরিবারের স্বজনরা।

কেমিক্যাল গোডাউন নিয়ে কী বলছে এলাকাবাসী

চুড়িহাট্টার এলাকার বসবাস করা লোকজন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, বারবার অভিযান হলেও শেষ পর্যন্ত গোডাউনগুলো বহাল তবিয়তে থেকেই যায়। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে ওই এলাকার সাধারণ মানুষের। চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের পর এ বিষয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তারা। কিন্তু রহস্যময় ভূমিকা বাড়ির মালিকদের। যারা কেমিক্যালের গোডাউন ভাড়া দেন, তারা কেমিক্যালের বিরুদ্ধে কথা বলতে রাজি না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দা সংবাদ প্রকাশকে বলেন, ৯০০ বর্গফুটের একটি বাসা ভাড়া দিলে সাত থেকে আট হাজার টাকা পাওয়া যায়। একই বাসা কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিলে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা ভাড়া পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা অগ্রিম দেন এই ব্যবসায়ীরা। যে কারণে ফ্যামিলির কাছে ভাড়া না দিয়ে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের কাছে দিতে মালিকরা আগ্রহী।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, পুরান ঢাকার লালবাগ, ইসলামবাগ, হাজারীবাগ, কোতোয়ালি, চকবাজার, বংশাল, শ্যামপুর, কদমতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে হাজার হাজার রাসায়নিক কারখানা। এসব কারখানায় তৈরি হচ্ছে, ব্যাটারি, পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক সরঞ্জাম, ঝালাই, খেলনা, জুতা-স্যান্ডেল, পারফিউম, বডি স্প্রে ইত্যাদি।

গোডাউনগুলোতে মজুত রাখা হয় গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোপাইলসহ তীব্র রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ। আগুনের ছোঁয়া পেলে বিস্ফোরিত হবে রাসায়নিক বোমা।

নিহতদের স্মরণে এলাকাবাসী

তিন বছর আগের এই দিনেই রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে কয়লা হয়েছিল ৭১ জন। এই ঘটনায় স্বজন হারানো প্রত্যেক পরিবারের হৃদয়েই তৈরি হয়েছে অসহ্য বেদনার ক্ষত। এমন ক্ষোভ রয়েছে এলাকাবাসীর মধ্য। চুড়িহাট্টার বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও এখনো হতাহত মানুষের স্বজনদের বুকের ভেতর জ্বলছে সেই আগুন। স্বজন হারানো বাসিন্দারা এখনো ডুকরে কাঁদেন সেই স্মৃতি মনে করে।

তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিবছরের মত এবারও এলাকাবাসী নিহতদের স্মৃতি স্মরণে ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে লাগিয়েছে ব্যানার ফ্যাস্টুন। 

dhaka
নিহতদের প্রতি শোক জানিয়েছে এলাকাবাসী। ছবি : সংবাদ প্রকাশ 

মামলার অগ্রগতি

চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় করা মামলার তিন বছরের মাথায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ভবনের মালিক দুই ভাই মোহাম্মদ হাসান সুলতান ও হোসেন সুলতানসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেছে পুলিশ। দুই ভাই ছাড়াও চার্জশিটে রাসায়নিকের গুদাম পার্ল ইন্টারন্যাশনালের মালিক ইমতিয়াজ আহমেদ, পরিচালক মোজাম্মেল ইকবাল, ম্যানেজার মোজাফফর উদ্দিন, মোহাম্মদ জাওয়াদ আতিক, মো. নাবিল ও মোহাম্মদ কাশিফের নাম রয়েছে। আদালতে চার্জশিট জমা দিলেও আট আসামির সবাই রয়েছেন জামিনে।

চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল কাইয়ুম সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “এ দুর্ঘটনা ঘটার আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মামলার তদন্ত কাজ চালাই। পুলিশ। এ সময় আমাদের বাইরেও এই ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বেশ কয়েকটি সংস্থার প্রতিবেদন আসার পর সবকিছু বিশ্লেষণ করে আমরা মামলার চার্জশিট তৈরি করেছি। যারা ঘটনার সঙ্গে প্রকৃতভাবে জড়িত ছিলো এমন ৮ জনের নামে চার্জশিট জমা দিয়েছি।
 

ক্ষতিপূরণ নিয়ে যা বলল ডিএসসিসি

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমরা নতুন প্রশাসন দায়িত্ব নিয়েছি ২০২০ সালে। আমাদের দায়িত্ব নেওয়ার আগে সাবেক মেয়র বা প্রশাসন চকবাজার চুড়িহাট্টার আগুনে ক্ষতিপূরণের কী আশ্বাস দিয়েছিল, তা আমাদের জানা নেই। আমাদের দপ্তরে কোনো ফাইল আমরা পাই নাই।”

২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চুড়িহাট্টার ৬৪, নন্দকুমার দত্ত রোডের ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতালার কেমিক্যাল গোডাউনের বিস্ফোরণ থেকে আগুন লাগে। এতে ৭১ জনের মৃত্যু ও ২০ জন আহত হন। এ ঘটনায় মামলা হয় ভবন মালিক মৃত হাজী ওয়াহেদের দুই ছেলে মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শাহীর বিরুদ্ধে।

Link copied!