বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত তৈরি পোশাকশিল্প। দেশের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের পাশাপাশি কোটি মানুষের কর্মসংস্থানে চার দশক ধরে বড় অবদান রেখে চলছে খাতটি। দীর্ঘদিন ধরে বৈশ্বিক মহামারি করোনার থাবায় বড় ধরনের ব্যবসায়িক ক্ষতির মধ্য রয়েছে তৈরি পোশাক পণ্যের রপ্তানিকারকেরা। প্রতিনিয়ত বন্ধ হচ্ছে কোনো না কোনো কারখানা। চাকরি হারাচ্ছেন শত শত শ্রমিক। তার মধ্যে শতভাগ রপ্তানিমুখী এই খাতে কিছু অসাধু চক্রের প্রতারণায় বিপুল পরিমাণ লোকসানের মুখোমুখি হচ্ছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক টপলুক ব্র্যান্ডের যোগসাজশে বায়িং হাউস ইউলো রিভার লিমিটেড ও ইউকে টেক্সটাইল গ্রুপ লিমিটেডের প্রতারণায় দেশের ১৪টি পোশাকশিল্পের প্রায় ৩০ লাখ ৭০ হাজার ৮৭০ মার্কিন ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত কারখানার মধ্য রয়েছে পোলো কম্পোজিট নিট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ডেনিম প্রসেসিং প্ল্যান্ট লিমিটেড, স্তোফাটেক্স ফ্যাশন লিমিটেড, বেবিলন কেজুয়্যালওয়ার লিমিটেডসহ ১৪টি প্রতিষ্ঠান। এসব কারখানার ভেতর পোলো কম্পোজিট নিট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড হলো অভিনেতা ও ব্যবসায়ী অনন্ত জলিলের মালিকানাধীন। এসব কারখানার সঙ্গে প্রতারণার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিকের বেতন-ভাতা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ওপর।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন থেকেই দেশের পোশাক রপ্তানি আয় প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। নানা প্রতিকূলতায় স্থবির হয়ে আছে দেশের ৮০ শতাংশের বেশি রপ্তানি আয় আসা এ খাতটি। হঠাৎ করে একটি অসাধু কোম্পানির খপ্পরে পড়ে বড় অঙ্কের ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা।
ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছর যুক্তরাজ্যভিত্তিক ব্যাংক ব্রাকলেসের মাধ্যমে ইউলো রিভার লিমিটেড ও ইউকে টেক্সটাইল গ্রুপ লিমিটেডকে ক্রয়াদেশ দেয় যুক্তরাজ্যভিত্তিক ব্রান্ড টপলুক। তখন এই দুটি বায়িং হাউস বেশ কয়েকটি অর্ডার দেয় ১৪টি পোশাক কোম্পানিকে। যার আনুমানিক বাজারমূল্য আট মিলিয়ন বা আশি লাখ মার্কিন ডলার। যথাযথ নিয়ম মেনে অনেক কোম্পানি অর্ডার করা সব পণ্য পাঠিয়ে দিয়েছেন, অনেকে আবার অর্ধেকটা পাঠিয়েছেন। অসম্পূর্ণ তৈরি পোশাক পরবর্তীকালে প্রস্তুত করে কারখানাগুলোতে রাখা হয়। এদিকে ডেলিভারি করা পণ্যের অর্থ ৪৫ দিন পর দেওয়ার কথা থাকলেও বায়িং হাউস কোম্পানি দুটি বারবার সময় দিয়ে অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হয়। পরে বায়িং হাউস দুটি কারখানার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ফলে বর্তমানে বিশাল অঙ্কের টাকা বকেয়া ও প্রস্তুত করা মালামাল ডেলিভারি না দিতে পারায় ১৪টি কোম্পানি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তের শিকার হয়।
এছাড়া ব্যাংকগুলো থেকে নেওয়া ঋণ ঠিক সময়ে পরিশোধ করতে না পারায় ব্যাংকের সঙ্গে কারখানা মালিকদের সম্পর্কেরও অবনতি ঘটছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে সামনের দিনে ব্যবসা পরিচালনা করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দাবি, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনেই তারা টপলুক ব্র্যান্ডের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করেছেন, কিন্তু টপলুক তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সততার পরিচয় দেয়নি।
টপলুক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক রফিকুল ইসলামের প্রতিষ্ঠান। তাদের প্রতারণার শিকার, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী এজে গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন চৌধুরী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, যুক্তরাজ্যভিত্তিক ব্র্যান্ড টপলুক দুটি বায়িং হাউসের মাধ্যমে ৫২ লাখ ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক পণ্যের ক্রয়াদেশ দেয় টপলুক। যার প্রথম ধাপে সাড়ে পাঁচ লাখ ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। বাকি অর্ডারগুলোর কাজ চলতে থাকে কারখানাগুলোতে। পরবর্তীকালে কয়েকবার যোগাযোগ করেও প্রথম ধাপের টাকা পরিশোধ করেননি তারা। পরে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, টপলুক একাধিক কোম্পানির সাথেই এমন করেছে অর্থাৎ পণ্য নিয়ে অর্থ পরিশোধ করেনি।
আনোয়ার হোসেন আরও বলেন, প্রথম ধাপের তৈরি পোশাক রপ্তানির পরে টাকা পরিশোধ না করায় অর্ডার করা অন্য পণ্যগুলো আমরা ডেলিভারি বন্ধ রাখি। যার ফলে গোডাউনে পরে আছে আমাদের কয়েক কোটি টাকার পণ্য। ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের প্রতিষ্ঠান।
এজে গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন আরও বলেন, “আমরা সব সময় ব্যাংক লোন নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করি। টপলুক ও বায়িং হাউজগুলোর যোগসাজশে এমন প্রতারণার কারণে আমরা এখন ব্যাংক লোন পরিশোধ করতে পারছি না। অন্যদিকে আর্থিক লোকসানে কারখানাগুলোতে কয়েক হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন ভাতা এখন হুমকির সম্মুখীন। পাশাপাশি কারখানা সচল রাখা আমাদের অন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।”
এদিকে নিয়ম অনুযায়ী বায়িং হাউস বা অর্ডার করা কোম্পানি যদি টাকা দিতে ব্যর্থ হলে দায় নেয় মধ্যস্থতাকারী ব্যাংক। সে অনুযায়ী টপলুক ব্র্যান্ডের এমন প্রতারণার দায়ভার নেবে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ব্যাংক ব্রাকলেস। কিন্তু টপলুকের এমন প্রতারণার পর নিরব ভূমিকায় আছে ব্যাংকটি।
টপলুকের এমন প্রতারণার শিকার ১৪টি প্রতিষ্ঠানের মালিক মিলে টপলুক ভেন্ডরস কমিউনিটি তৈরি করেছে। এই কমিউনিটি টপলুকের এমন প্রতারণার জবাবে সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, কিন্তু আশানুরূপ সাড়া মিলছে না কোনো পক্ষ থেকেই। টপলুকের এমন প্রতারণার বিষয়ে কথা হয় কমিউনিটির আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, যুক্তরাজ্যভিত্তিক ব্রাকলেস ব্যাংকের মতো স্বনামধন্য একটা ব্যাংক, তাদের ভুল হোক বা যেটাই হোক, তাদের গুড উইলের কারণে হলেও তারা আমাদের পেম্যান্টগুলো দেবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সেক্ষেত্রে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকসহ যে এডি ব্যাংকগুলো আছে তাদের মাধ্যমে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। আশা করছি আমরা হয়তো কিছুটা সমাধান করতে পারব।”
এদিকে পণ্য রপ্তানির পর সঠিক সময়ে টাকা না এলে কোম্পানিগুলোর অথোরাইজড ব্যাংককে (এডি ব্যাংক) জবাবদিহি করতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। এমন অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত ১৪টি কারখানা মালিক সমাধানের জন্য চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ পোশাক রফতানিকারক ও মালিক সমিতি বিজিএমইএকে।
বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজীম সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “টপলুকের দুটি বায়িং হাউজ ইউলো রিভার লিমিটেড ও ইউকে টেক্সটাইল গ্রুপ লিমিটেডের এমন প্রতারণার বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মালিকরা সমাধানের জন্য আমাদের চিঠি দিয়েছে। বিজিএমইএ এখানে দুই পক্ষকে ডেকে সমাধান করতে চেষ্টা করবে। বিজিএমইএ এখানে বায়িং হাউস ও কারখানা মালিক উভয়ের স্বার্থ দেখবে।”
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা জানান, বায়ারদের কাছ থেকে পাওনা অর্থ না পাওয়ার কারণে ব্যাংকের সঙ্গে নতুন ঋণপত্র খোলা নিয়েও ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে তাদের। ব্যবসায়ীদের জন্য যেহেতু ব্যাংকের ফোর্সলোন নিতে হচ্ছে তাই এটা নিয়েও পরিস্থিতি জটিল রূপ ধারণ করছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। কারণ ব্যাংক তাদের ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করছে।
এদিকে, সঠিক সময়ে পাওনা পরিশোধ না হলে ইডিএফ ও ক্যাশ ইনসেনটিভের মতো সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হবে ব্যবসায়ীরা।