কৃষির আধুনিকায়নে যান্ত্রিকীকরণে ৭০ ভাগ ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, “আমাদের জীবনধারার উত্তরণের পথে প্রথম সোপানই কৃষি। এছাড়া মৌলিক বিপ্লব কৃষি। হাওর এলাকায় কৃষকদের জীবনধারা কেমন, সেটা আমি নিজেই দেখেছি।”
বুধবার (২ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর খামারবাড়িতে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনের কেআইবি কমপ্লেক্স হলে ওয়েল্ট হাঙ্গার লাইফ (ডব্লিউএইচএইচ) এবং ফ্রেন্ডস ইন ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশের (এফআইভিডিবি) যৌথ একটি প্রকল্পের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, “হাওর এলাকায় আমিও জীবনযাপন করেছি। সেখানে অনেক সংগ্রামী জীবন। শহরে আসার আগে বুঝিনি। হাওরে দরিদ্র মানুষ বেশি। আর দারিদ্র্যকে মোকাবিলার মাধ্যম হলো উৎপাদন। তবে কৃষির উন্নয়নে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বেসরকারি সংস্থাগুলোও ভালো কাজ করছে।”
পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, “আগে বিল এবং জলাশয়গুলোতে মানুষ মাছ ধরত, কিন্তু এখন তা সম্ভব হয় না। কারণ, এগুলো সরকার ইজারা দিয়ে কিছু টাকা পায়। খাসজমিগুলোর ওপর দরিদ্র মানুষ হাত দিতে পারে না। অসম আইনের বেড়াজালে আটকে থাকে তারা। এটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। দারিদ্র্য মোকাবিলায় কৃষি হলো আধুনিক মাধ্যম।”
বক্তারা বলেন, ওয়েল্ট হাঙ্গার লাইফ (ডব্লিউ এইচ এইচ) এবং ফ্রেন্ডস ইন ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশ (এফআইভিডিবি) সিলেটের ঝুঁকিপূর্ণ হাওর অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করার জন্য কৃষক এবং গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের শক্তিশালী করার লক্ষ্যে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। প্রকল্পের সামগ্রিক উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কৃষি বৃদ্ধি করা।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার।
প্রকল্প উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সার্ক অ্যাগ্রিকালচার সেন্টারের (এসএসি) পরিচালক ড. মো. বক্তার হোসেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. দেবাশীষ সরকার এবং কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ূন কবির অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর বলেন, “পিছিয়ে পড়া কৃষকদের এই প্রকল্পের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কৃষি উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। আর সরকার সে জন্য চেষ্টা করছে। দেখা যায়, আমাদের শুধু পোল্ট্রিতে ১৮ লাখ মেট্রিক টন চাল ব্যবহার হচ্ছে।” তিনি আরও বলেন, “পুষ্টিজাতীয় খাবার আমাদের তৈরি করতে হবে। আমরা যেন নিরাপদ ও পুষ্টিজাতীয় খাবার পাই সে জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের জন্য কাজ করে যাব।”
মো. বেনজীর আরও বলেন, “সরকারের পক্ষ থেকে একজন কৃষককে ২১ লাখ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে কৃষিযন্ত্র দেওয়া হচ্ছে। সাড়ে ৭ একর যাদের আছে তারা হলেন সাধারণত বড় চাষি। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কৃষিকে আমরা আধুনিকায়ন করতে পারব।”
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. দেবাশীষ সরকার বলেন, “একটি প্রকল্পের মাধ্যমে সুনামগঞ্জের ৩টি উপজেলায় কাজ করা হবে। নতুন নতুন জাত এবং প্রযুক্তি কৃষকদের জন্য আমরা তৈরি করব।”
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. শেখ মোহাম্মদ বখতিয়ার বলেন, “আমাদের জমির পরিমাণ কমছে অথচ জনসংখ্যা বাড়ছে। এদিকে দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ আলু উৎপাদন হয় মুন্সিগঞ্জে। কিন্তু এবার এমন উৎপাদন হবে কি না, তা আশঙ্কাজনক। এ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের কাজের অনেক সুযোগ রয়েছে। হাওর এলাকায় বড় ধরনের কাজে আমরা যাব।”
এফআইভিডিবির নির্বাহী পরিচালক বজলে মোস্তফা রাজীর স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর ডব্লিউএইচএইচ বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মামুনুর রশীদ প্রকল্পের লক্ষ্য, ফলাফল, এবং স্টেকহোল্ডারদের বিষয়ে উপস্থাপনা করেন।
জানা যায়, প্রকল্পটি আগামী তিন বছরের জন্য সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ (দক্ষিণ সুনামগঞ্জ), বিশ্বম্ভরপুর ও দিরাই উপজেলা এবং সিলেট ও ঢাকা শহরে বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হলো “কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জীবিকার ওপর জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাবের প্রতি বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সহনশীলতা বৃদ্ধি করা।
বাংলাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ হাওর অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করার জন্য ক্ষুদ্র কৃষকদের এবং গ্রামীণ উদ্যোগকে শক্তিশালীকরণ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে হাওরবাসীদের কৃষি উৎপাদন, জীবিকা, খাদ্য নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রকল্পের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে, সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ (দক্ষিণ সুনামগঞ্জ), বিশ্বম্ভরপুর এবং দিরাই উপজেলার ২০ হাজার ক্ষুদ্র কৃষককে জলবায়ু সহনশীলতা এবং পরিবেশ সম্মত কৃষির জন্য সহায়তা করা হবে এবং জৈব নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, গ্রামীণ উদ্যোক্তা তৈরি এবং একটি টেকসই বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সহায়তা করবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রকল্পটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) বিএএমআইএস প্রকল্প (বাংলাদেশ এগ্রো মেটিওরোলজিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেমস), পিজিএস সার্টিফিকেশনের জন্য (আইএফওএম)-এর সহায়তায় বাংলাদেশ অর্গানিক অ্যাগ্রিকালচার নেটওয়ার্ক (বিওএন)-বারি, কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটি (বিএফএসএ), বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (এসসিআইটিআই), কৃষি বিপণন বিভাগ, প্রাণীসম্পদ বিভাগ ও মৎস্য অধিদপ্তরের সঙ্গে কাজ করবে।
প্রকল্পটি মোট ২০ হাজার ক্ষুদ্র কৃষকের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে এবং আরও ১ লাখ কৃষকের সঙ্গে পরোক্ষভাবে কাজ করবে। এই প্রকল্পটি ১০ লাখ ভোক্তাদের মাঝে জৈব/নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতেও কাজ করবে।
অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিরা আশা প্রকাশ করেন যে, জার্মানভিত্তিক দাতা সংস্থার অর্থায়নে প্রকল্পটির যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে এফআইভিডিবি সুনামগঞ্জ জেলার হাওর এলাকার ক্ষুদ্র কৃষকদের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এছাড়া প্রকল্পের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে অতিথিরা তাদের মতামত ব্যক্ত করেন।