• ঢাকা
  • রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬
‘সংসারের চাকা আর চলে না’

বাজারে কাজে আসেনি ‘সর্বশক্তির হুঁশিয়ারি’


মো. মির হোসেন সরকার
প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০২৩, ০৯:২২ পিএম
বাজারে কাজে আসেনি ‘সর্বশক্তির হুঁশিয়ারি’
গ্রাফ : সংবাদ প্রকাশ

‘দর নির্ধারণ করে দায় সারলে হবে না। মাঠ পর্যায়ে কার্যকর করতে হবে। ভোক্তা অধিদপ্তরের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং কৃষি, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে নিয়ে সমন্বিত বাজার তদারকি নিশ্চিত করতে হবে’

মুজিবুর রহমান। পেশায় রিকশাচালক। কাঠ-ফাটা রোদে রিকশা চালিয়ে উপার্জন করেন। দিনে বড়জোড় ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা আসে। এও খুব কঠিন! দৈনিক গ্যারেজ ভাড়া পরিশোধ করে যা থাকে, তা দিয়ে কোনোমতো পরিবার নিয়ে চলতে পারেন তিনি। বাজারে নিত্যপণ্যের লাগামছাড়া দামে সেও কঠিন হয়ে পড়েছে। পরিবার নিয়ে জীবনযাপন করা তার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।

মুজিবুর রহমান সংবাদ প্রকাশকে বলেন,“ খুব কষ্টে আছি। সকালে বাসা থেকে একপেট খেয়ে রিকশা নিয়ে বের হই। বাসায় যাই রাত ১০ টার সময়। সারাদিনে চা, সিংরা, রুটি দিয়ে দিনপার করি। বাজারে যে হারে সবকিছুর দাম বাড়ছে, তাতে ঢাকা শহরে চলা আর সম্ভব নয়।”

এ তো গেলো এক মুজিবুর রহমানের ভাষ্য। এমন অনেক মুজিবুর রহমান আছেন, যারা নিত্যপণ্যের লাগামছাড়া দামে এখন দিশেহারা। সবজি কিনতে গেলে মাছ হয় না। মাছ কিনতে গেলে চাল, ডাল, তেল হয় না। আর গরুর গোশত তো দূরেই থাকলো।

তথ্য বলছে, তিন কৃষিপণ্য আলু, পিঁয়াজ এবং ডিমের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। আলুর সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য প্রতি কেজি ৩৫-৩৬ টাকা, দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৬৪-৬৫ টাকা। আর প্রতিটি ডিমের মূল্য ১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দাম নির্ধারণের এ তথ্য জানান, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সেসময় বাণিজ্যমন্ত্রী এই ঘোষণার পর সর্বশক্তি দিয়ে বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন। কিন্তু সেই ঘোষণার সাড়ে ছয় সপ্তাহ পার হলেও বেঁধে দেওয়া দামে পণ্য মিলছে না বাজারে। আবার নতুন করে কোল্ড স্টোরেজ পর্যায়ে কেজিপ্রতি ২৬-২৭ টাকায় আলু বিক্রি নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যা আজ বুধবার (১ নভেম্বর) থেকে বাস্তবায়ন করার কথা রয়েছে।

জানা যায়, অতি মুনাফার লোভে বাজারে ব্যবসায়ীদের দাম বৃদ্ধির যেন প্রতিযোগিতা চলছে। এ যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হলেও তা সামান্য বলে মনে করছেন ভোক্তারা।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সবজি কিনছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মো. নাজমুল হক। মুলাশাকের প্রতি আটি ২০ টাকা শুনে দোকানদারের ওপর চটেছেন তিনি। নাজমুল হকের সঙ্গে কথা হলে তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “বাজারে এসে শুধু জিনিসপত্রের দাম জিজ্ঞেস করে যাচ্ছি। কোনো কিছু কিনতে গেলেই ভাবতে হচ্ছে। এটা কিনবো নাকি ওটা কিনবো। নিত্যপণ্যের দাম যে হারে বাড়ছে, তাতে না খেয়ে মরা ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না।”

নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য গত দুমাস ধরেই চলছে। এরমধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে সবজির চড়া দাম। বাজারে শীতকালীন সবজির দেখা মিললেও নানা অজুহাতে বেশি দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ এখন নতুন অজুহাত হিসেবে যুক্ত হয়েছে।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, করোনা মহামারির রেশ কাটতে না কাটতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এসব কারণে সারাবিশ্বে অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা। নতুন করে ইসরায়েল-হামাসের সংঘাত চলমান। যা বিশ্ব অর্থনীতিতে ফের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ব্যাংকে ডলার সংকট, রিজার্ভ কমে যাওয়াসহ রফতানিও কমে গেছে।

অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “একদিকে আমদানির ক্ষেত্রে উচ্চ মূল্য,তাই পর্যাপ্ত আমদানি করা যাচ্ছে না। এরপর বাজারে পণ্য সংকট রয়েছে। যেভাবে সাপ্লাই আসার দরকার সেভাবে আসছে না। এ সমস্ত চ্যালেঞ্জ তো আছেই। সরকারও হয়তো নির্বাচনের আগে বড় কোনো অ্যাকশনে যেতে চাচ্ছেন না। সেটাও কিছুটা অনুমান করা যায়। বাজারে পর্যাপ্ত পণ্য পাওয়া যাবে না। যার ফলে হবে পণ্য ভুক্তিজনিত মূল্যস্ফীতি, সেই মূল্যস্ফীতিটা হয়তো সামনের দিনগুলোতেও থাকবে।”

তিনি আরও বলেন, “এমনি এটা আমাদের উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়। সেই চ্যালেঞ্জ তো আছেই। যেহেতু আমদানির ক্যাপাসিটি কম, সুতারাং সেটা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আবার উৎপাদনও সীমিত। ফলে এক ধরনের ঘাটতির চ্যালেঞ্জ থাকবেই। তবে সেটা এখন বেশিই হয়ে গেছে। এটা বাজারকেন্দ্রিক অনিয়মের জন্য। সেটা আমার ধারণা, নির্বাচনের পর পর্যন্ত এগুলো থাকবে।”

এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, “দেখবার বিষয়- সরকার ভবিষ্যতে (যে সরকারই আসুক) বাজার উন্নয়নের জন্য কি ধরনের সংস্কার উদ্যোগগুলো নেয়। একটা বড় জায়গা হতে পারে, যেই রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, তারা নির্বাচনে মূল্যস্ফীতিকে গুরুত্ব দিয়ে কি ধরনের উদ্যোগ আগামীতে নিবে বলে ঘোষণা দেয়, সেটা দেখা। একইসাথে সে অনুযায়ী তারা কাজ করবে কিনা। আমাদের মনে হয়, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার। বাজারে সাপ্লাই চেইনগুলোকে ফরমাল সাপ্লাই চেইন করা দরকার। সকল মার্কেট এজেন্সির লাইসেন্স থাকা দরকার। ট্রান্সজেকশনগুলো যতদূর সম্ভব ব্যাংকিং চ্যানেলে হওয়া উচিত।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, “বাজারে কারসাজি চলছে। তাই দর বেঁধে দেওয়াকে স্বাগত জানাই। কিন্তু বাজারে সেই চিত্র দেখা যায়নি। দর নির্ধারণ করে দায় সারলে হবে না। মাঠ পর্যায়ে কার্যকর করতে হবে। ভোক্তা অধিদপ্তরের পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং কৃষি, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে নিয়ে সমন্বিত বাজার তদারকি নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, “ব্যবসায়ীরা বাজার তদারকিকে হাস্যকর করার জন্য নানা ফন্দি-ফিকির করতে চান। এজন্য আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে যেসব পণ্য নিয়ে কারসাজি হয়, সেগুলো দ্রুত আমদানি করতে হবে।”

Link copied!