পাইকারদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সবজি আসে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে। এসব সবজি আড়ত থেকে মাত্র এক হাত বদলি হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ দামে। কোনো কোনো সবজি প্রকারভেদে হয়ে যাচ্ছে কয়েক গুণ।
এতে কৃষকেরা প্রতিনিয়ত পাইকারি বাজারের মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে জিম্মি হচ্ছেন। খুচরা বাজারে সবজির এই উচ্চ মূল্য সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ বিষয়ে কথা হয় কুড়িগ্রামের ফুলকপিচাষি মো. আলতাফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমি একজন সাধারণ কৃষক। গ্রামে চাষাবাদ করি। যা দিয়ে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ ও সংসার চালাই। এ বছর এক বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করেছি। এক বিঘাতে সাধারণত ৮০-৮৫ মণ (সাড়ে ৩ হাজার পিস) পর্যন্ত ফুলকপি চাষ হয়। ২০ টাকা করে বিক্রি হলে সাড়ে ৩ হাজার কপি বিক্রি হয় ৭০ হাজার টাকা। এতে খরচ (১৫ হাজার টাকা) বাদে লাভ হয় ৫৫ হাজার টাকা।“
কৃষক আলতাফ হোসেনের তথ্যানুযায়ী, কৃষকের কাছ থেকে ২০-২৫ টাকা পিস ধরে পাইকারেরা কিনে নেন, যা পরে রাজধানীর বাজারগুলোতে বিক্রি হয় ৬০-৮০ টাকা পর্যন্ত।
ডিজেলের দাম বাড়ার আগের ও পরের মূল্য পর্যালোচনায় দেখে গেছে, মাঠপর্যায়ে কাঁচামালের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। শীতকালীন সবজির উৎপাদন বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাজারে সবজির দাম তুলনামূলক কম হওয়ার কথা। কিন্তু সবজির দাম না কমে দেড় থেকে দুই গুণ বেড়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির হার আরও বেশি।
সবজির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষক থেকে শহরের ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত হাতবদল কমাতে হবে। সম্প্রতি এমন সুপারিশ করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় একটি সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদনে।
তবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যেকোনো সবজি শহরের ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর আগে বেশ কয়েকবার হাত বদল হয়। হাতবদল, যানবাহন ব্যবহার ছাড়াও অসাধু ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফালোভী মনোভাব, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যানজটসহ নানা কারণে বাজারে সবজির দাম বাড়ে। পাইকারি ক্রয়মূল্যের শতকরা ৭০-৮০ শতাংশ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশি লাভ করার প্রবণতা খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে লক্ষ করা গেছে।
এদিকে দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে সবজির চাহিদার বড় অংশ পূরণ করা হলেও সেখানে তেমন বড় কোনো পাইকারি বাজার নেই। এ কারণে রংপুর, বগুড়া, নাটোরসহ বেশ কয়েকটি জেলা থেকে সবজি গাড়িতে করে বড় পাইকারি বাজার কারওয়ান বাজারে আড়তে নিয়ে আসা হয়। এখান থেকে আবার হাত বদল হয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য জেলা শহরে সবজি নিয়ে যাওয়ার জন্য আরেক দফা অতিরিক্ত পরিবহন খরচ যুক্ত হয়। এসব জায়গায় হাত বদলের কারণেও সবজির দাম বাড়ছে।
কারওয়ান বাজার থেকে যারা পুনরায় পণ্য পাইকারি বাজারে বিক্রি করতে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় নেন, তাদের পণ্যবাহী বাহনেও বিভিন্ন রকমের খরচ করতে হয়।
নাম প্রাকশে অনিচ্ছুক একজন জানান, কারওয়ান বাজারে ৪০০ বর্গফুট জায়গা প্রতি রাতের জন্য ভাড়া দিতে হয় ২ হাজার ১০০ টাকা এবং একই জায়গায় প্রতিদিনের জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা দিতে হয়। এই টাকার হিসাব পণ্যের ওপর যুক্ত হয়, যা দাম বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। শুধু কারওয়ান বাজারের হিসাব নয়। এর বাইরেও অনেক খরচ করতে হয়।
কুড়িগ্রাম ধরলা ব্রিজ হয়ে রংপুর মডার্ন দিয়ে বগুড়ার মহাস্থানহাট থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত প্রতিটি পণ্যবাহী ট্রাককে যেসব ঘাটে চাঁদা দিতে হয়, তার একটি তালিকা সংবাদ প্রকাশের হাতে এসেছে।
মো. জামিল উদ্দিন নামের একজন বলেন, “ঢাকা-কুড়িগ্রাম রোড়ে চলাচল করতে বিভিন্ন টোলসহ পুলিশকেও টাকা দিতে হয়। কুড়িগ্রাম পৌরসভার ৫০ টাকা টোল দিয়ে যাত্রা শুরু করতে হয়। তার পর বগুড়া পৌরসভায় ৫০ টাকা দেওয়ার পরে শেরপুরে ৫০ টাকা, সিরাজগঞ্জ ট্রাক মালিক-শ্রমিক সমিতিতে ৫০ টাকা, সিরাজগঞ্জ শহরে গাড়ি ঢুকলে ৫০ টাকা, সিরাজগঞ্জ মোড় হাইওয়ে পুলিশ খরচ (মাসিক) ৫০০ টাকা, যমুনা সেতু গোলচত্বর হাইওয়ে পুলিশ খরচ (মাসিক) ৫০০ টাকা, টাঙ্গাইল মোড় হাইওয়ে পুলিশ খরচ (মাসিক) ৫০০ টাকা, আমিনবাজার, সাভার (লাঠিয়াল বাহিনী) প্রতি ট্রিপ ১০০ থেকে ২০০ টাকা, কারওয়ান বাজার পার্কিংয়ে ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এ ছাড়া প্রতি ট্রিপে যুমনা সেতুতে টোল দিতে হয় ১ হাজার ৪০০ টাকা।”
জামিল উদ্দিন আরও বলেন, “কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকায় আসায় প্রতিটি ৫ টনের ট্রাকের প্রতি ট্রিপে ডিজেলে সাড়ে ছয় হাজার টাকা, চালক-হেলপারের বেতন ২ হাজার টাকা এবং সড়ক খরচ ২ হাজার টাকা। যদিও ৫ টনের ট্রাকে সাধারণত ১২ থেকে ১৩ টন সবজি পরিবহন করা হয়।”
ট্রাকচালক মো. জামিল উদ্দিন বলেন, “একটি ৫ টন ট্রাক ১ লিটার ডিজেল তেলে আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার যায়। ৩ টন মিনি ট্রাক ১ লিটারে যায় ৫-৬ কিলোমিটার। এক থেকে ২ টন পিকআপ এক লিটারে যায় সাত থেকে সাড়ে সাত কিলোমিটার। এ হিসাবে কুড়িগ্রাম থেকে ৩৫২ কিলোমিটার দূরত্বে ঢাকা যেতে গড়ে ডিজেল লাগে পাঁচ টন ট্রাকের ৮০ থেকে ৮১ লিটার। সম্প্রতি ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ১০৯ টাকায় ডিজেল বাবদ খরচ হয় ৮ হাজার ৭২০ টাকা। ডিজেলের দাম বাড়ার আগে খরচ হতো ৬ হাজার ৪০০ টাকা। এ হিসেবে বর্তমানে ডিজেল বাবদ অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে ২ হাজার ৩২০ টাকা।“
যেহেতু অন্যান্য খরচ আগের মতোই রয়েছে, তাই ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে পাঁচ টনের একটি ট্রাকের ভাড়া সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা বাড়ার কথা। অথচ ট্রিপপ্রতি পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। এ কারণে কাঁচামালের বাজার বেড়েই চলেছে।
                
              
																                  
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    




























