সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয় ভারত আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের ‘টু-প্লাস-টু’ বৈঠক। তাতে ভারত একটি বিষয় স্পষ্ট করেন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে। তা হলো বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ দেশের স্থিতিশীলতা তারা আশা করছেন। ভারত বলেছে, তারা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নাক গলাবেন না এবং যুক্তরাষ্ট্রকেও বলেছেন অতিরিক্ত চাপ দেওয়া থেকে বিরত থাকতে। শুধু তাই নয়, নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রকে কড়া বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত। এতে আওয়ামী লীগের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি বিরাজ করছে।
ওই বৈঠকে বাংলাদেশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে জানান ভারতের বিদেশ সচিব ভিনয় কোয়াত্রা। তিনি জানান, একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশকে সেদেশের মানুষ যেভাবে দেখতে চায়, সেই ‘ভিশন’কে ভারত কঠোরভাবে সমর্থন করে। তিনি এটাও বলেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচন সেদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং সেখানকার মানুষই তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের পরে ওইদিন সন্ধ্যায় যৌথ বিবৃতি জারি করে ভারত আর যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে অবশ্য বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা হয়নি। নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে তুলে ধরার বিষয়টিকে বিশ্লেষকরা ব্যাখ্যা করছেন যে আমেরিকা যাতে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বেশি চাপ না দেয়, সেই বার্তাই যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছে ভারত।
এই বিষয়ে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্রকে ভারত যা বলেছে, তাতে এটি পরিষ্কার যে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার যে পরিবেশ ভারত উপভোগ করছে সেটিকে তারা নষ্ট হতে দিতে চায় না।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে দেওয়া ভারতের বক্তব্য কূটনীতির কড়া বার্তা বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ভারতের এই বক্তব্যের মাধ্যমে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে মার্কিনীদের নাক না গলানোর বার্তা স্পষ্ট হয়েছে বলে মনে করেন তারা।
এদিকে গত ২৮শে অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর বিষয়ে যে অবস্থান নিয়েছে সেটি আরও জোরালো হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলছেন অনেকে। এতে তাদের মনোবল আরও বাড়তে পারে, তা অন্যরা যা-ই মনে করুক না কেন। ভারতের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারই যে কোনো পরিস্থিতিতে কাম্য।
এ বিষয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, “ভারতের অবস্থানের কোনো প্রতিফলন এখানে আসার সুযোগ নেই কারণ নির্বাচনটি একান্তই বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়। তিনি বলেন, “যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং সংবিধান অনুসারে হবে।”
বিএনপির অবরোধ প্রসঙ্গে আব্দুর রহমান বলেন, “সরকার উৎখাতের অংশ হিসেবে বিএনপি অবরোধের নামে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা করছে। মানুষ তাদের ক্ষমতায় দেখতে চায় না। তাই অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে ক্ষমতায় যাওয়ার অপচেষ্টা করছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তা প্রতিহত করবেন রাজপথে। মানুষের ভোগান্তি দূর করতে, দেশের উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে জনগণকে নিয়ে তারা রাজপথে রয়েছেন।”
কূটনীতিক মহলে বার্তা সুস্পষ্ট করেছে আ.লীগ
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি আসবে কি আসবে না এটি বিএনপির একান্ত নিজস্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ কোনো হস্তক্ষেপ করবে না এবং নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে ছাড় দেবে না। একাধিক কূটনীতিক মহলের কাছে আওয়ামী লীগ তার অবস্থান এবং বার্তা সুস্পষ্ট করেছে। তফসিলের আগেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একটি সমঝোতার চেষ্টা করছে বিভিন্ন দূতাবাস। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তারা আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তত দুইজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছেন। তবে আলোচনার মাধ্যমে ইতিবাচক কোনো ফল আসেনি। বরং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে, নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপিকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। কূটনীতিক মহল থেকে আওয়ামী লীগের কাছে পাঁচটি সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
প্রথমত কূটনীতিকরা বলেছিলেন, বিএনপির যেসব নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে সেসব নেতাকর্মীদের যেন মুক্তি দেওয়া হয়। জবাবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কাউকে রাজনৈতিক কারণে গ্রেপ্তার করা হয়নি। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। তারপরও সরকার এই সমস্ত গ্রেপ্তারদের ব্যাপারে বিশেষ বিবেচনা করবে। তবে সবার আগে বিএনপিকে নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিতে হবে এবং আন্দোলন প্রত্যাহার করতে হবে। বিএনপি যতক্ষণ পর্যন্ত আন্দোলন প্রত্যাহার না করবে এবং নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা না দেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের কোনো রকম ছাড় দেওয়া হবে না বলেই আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কূটনীতিক মহল আওয়ামী লীগের কাছে দ্বিতীয় যে প্রস্তাব দিয়েছিল তা হলো, বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনকালীন সরকার এবং নির্বাচনের সময় কীভাবে দেশ পরিচালিত হবে সে ব্যাপারে একটি মাঝামাঝি অবস্থানে আসা। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানার প্রয়োজন নেই। কিন্তু অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যেন হয় সেটির ব্যাপারে দুপক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতার চেষ্টা হতেই পারে এমন একটি মনোভাব দেখিয়েছিল বিদেশি দূতাবাসগুলো।
এর জবাবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী। সংবিধানে যেভাবে আছে সেভাবেই নির্বাচন হবে। আর এই ধরনের সমঝোতা বা আলোচনা তখনই হতে পারে যখন বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে।
তৃতীয়ত, যে বিষয় নিয়ে কূটনীতিক মহল আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলাপ করছিল, তা হলো- বিরোধীদল হিসেবে বিএনপিকে নির্বাচনে সমান সুযোগ সুবিধা দেওয়া এবং একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা।
জবাবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে বিরোধীদল হলো সেই দল যারা সংসদে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে থাকে। বাংলাদেশে এখন বিরোধীদল হল জাতীয় পার্টি। আর যেহেতু বিএনপির সংসদে অবস্থান নেই। কাজেই তারা স্বীকৃত বিরোধীদল নয়। এ কারণেই বিএনপি সমান সুযোগ সুবিধা পাবে না। তবে একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের যা প্রাপ্য সেটি দিবে। নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।