• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

রপ্তানিতে বড় ধসের শঙ্কা


মো. মির হোসেন সরকার
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৪, ০৯:৫৭ পিএম
রপ্তানিতে বড় ধসের শঙ্কা

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তৈরি পোশাক ও চামড়াসহ ৪৩ খাতের পণ্যে নগদ রপ্তানি প্রণোদনা কমিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন-পরবর্তী সময়ে রপ্তানি প্রণোদনা/নগদ সহায়তা সম্পূর্ণভাবে একত্রে প্রত্যাহার করা হলে রপ্তানি খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। সেজন্য সরকার এখন থেকেই বিভিন্ন ধাপে নগদ সহায়তা/প্রণোদনার হার অল্প অল্প করে কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তথ্য বলছে, আগে রপ্তানি আয়ের ওপর ১ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ সহায়তা প্রদান করা হতো, যাতে রপ্তানিকারকদের উৎসাহিত করা যায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা যায়। এখন নতুন ঘোষণার পর সর্বোচ্চ হার ১৫ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন ০.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাকি ছয় মাসে রপ্তানির বিপরীতে নগদ প্রণোদনার নতুন এই হার নির্ধারণ করে দিয়েছে।

তৈরি পোশাক ও চামড়াসহ ৪৩ পণ্যে সরকারের নগদ প্রণোদনা কমিয়ে দেওয়ায় হতাশ ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, পণ্যে প্রণোদনা কমানোর বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এটা করা যেতে পারত। বিশ্ব অর্থনীতির এই টালমাটাল পরিস্থিতি সঙ্গে চলমান ডলার সংকটসহ নানা কারণে তৈরি পোশাক খাত চাপে আছে। এর সঙ্গে সরকারের এমন সিদ্ধান্তের ফলে পোশাককর্মীদের মজুরিসহ আরও অনেক সুবিধা অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে। অনেকে চাকরি হারাতে পারেন। কারণ প্রণোদনার অর্থ দিয়ে তাদের বেতন দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম বলেন, “সরকারের এমন সিদ্ধান্তের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে নিট সেক্টর এবং ব্যাকওয়ার্ড ইন্ডাস্ট্রির স্পিনিং মিলগুলো। আমরা যে পোশাক রপ্তানি করি, তার ৫৬ শতাংশ হলো নিট পোশাক। এই খাতে পুরোই নগদ সহায়তা তুলে দেওয়া হয়েছে। এটাই আমাদের মূল উদ্বেগের বিষয়।”

মো. হাতেম আরও বলেন, “আমরা এই খাতের স্টেক হোল্ডার। আমাদের সঙ্গে কথা না বলে এই সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হলো। আমাদের সঙ্গে আলাপ করে কোন খাতে কীভাবে পর্যায়ক্রমে নগদ সহায়তা ২০২৬ সালের মধ্যে তুলে নেওয়া হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতো। সেটা সহনীয় হতো। আমরাও প্রস্তুতি নিতে পারতাম। কিন্তু এখন আমরা সংকটের মধ্যে পড়ে গেছি।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, দেশের রপ্তানি বাণিজ্যিকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকার চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৩টি খাতে রপ্তানির বিপরীতে রপ্তানি প্রণোদনা/নগদ সহায়তা প্রদান করছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন) বিধিবিধান অনুসারে বিষয়টি রপ্তানিনির্ভর সাবসিডি হিসেবে বিবেচিত হয়। এলডিসি থেকে বেরিয়ে এলে এ ভর্তুকি তুলে নিতে হবে; গ্র্যাজুয়েশনের বাকি সময়ে যাতে চাপ না হয় সেজন্য পর্যায়ক্রমে নগদ প্রণোদনা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধিবিধান অনুসারে, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ হলে কোনো ধরনের রপ্তানি প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা দেওয়া যায় না। তবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর একবারে নগদ সহায়তা প্রত্যাহার করা হলে রপ্তানি খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। সেজন্য চলতি বছর থেকে অল্প অল্প করে নগদ সহায়তা কমানোর বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, রপ্তানি প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা পেতে আগের মতো সব শর্ত মানতে হবে। বহিঃনিরীক্ষক দিয়ে নিরীক্ষা করার বিষয়েও আগের মতো বাধ্যবাধকতা থাকবে। চলতি অর্থবছরের জন্য রপ্তানি বাণিজ্যের ৪৩ খাতে রপ্তানি প্রণোদনা, নগদ সহায়তা, বিকল্প সহায়তা, বিশেষ সহায়তা ও ভর্তুকির নামে উদ্যোক্তাদের সুবিধার ঘোষণা দেওয়া হয় ২০২৩ সালের আগস্টে। ওই সময়ে পুরো অর্থবছরের জন্য সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও ছয় মাস পর নতুন হার ঠিক করল সরকার।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। এই রপ্তানি তার আগের অর্থবছরের তুলনায় ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি ছিল। তবে চলতি অর্থবছরে প্রথমার্ধে প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে। অর্থবছরে প্রথম ছয় মাসে ২ হাজার ৭৫৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ৮৪ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রপ্তানিতে নগদ সহায়তার প্রভাব খারাপ হবে। তবে রপ্তানিতে প্রণোদনা বা ভর্তুকি অনন্তকাল ধরে চলতে পারে না। কারণ নগদ সহায়তার ওপর বেশি নির্ভরশীল হলে নিজেরা কোনো নতুন উদ্যোগ নেওয়ার চিন্তা করবে না। যেকোনো সংকট মুহূর্ত এলেই সরকারের সাহায্য নিতে হবে এমন চিন্তা-ভাবনা অর্থনীতির জন্য খুব একটা ভালো নয়। সরকারের উচিত এখন ব্যবসার ক্ষেত্রে যেসব অদক্ষতা ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা আছে, সেগুলোর উন্নতি করা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “প্রণোদনা তুলে দেওয়া ভালো না খারাপ এই বিতর্কের এখন আর আমাদের সুযোগ নেই। আমাদের আইনি কাঠামোর দিক দিয়ে চিন্তা করতে হবে। এগুলো তুলে দিতে হবে। না দিলে ২০২৬ সালে আমাদের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতি অনুযায়ী শাস্তির মুখে পড়তে হবে। তাই এই কাজে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।”

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, একবারে নয়, ধাপে ধাপে তুলে দেওয়া হচ্ছে। আমার বিবেচনায় অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য এটা যতদিন বেশি রাখা যায়, সেটা করা উচিত। পোশাক খাত এরই মধ্যে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জন করেছে। আর নগদ সহায়তার ব্যাপারে একটি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে, যারা এখান থেকে টাকাটা নিয়ে নেয়। ফলে এটা পর্যায়ক্রমে তুলে নিলে পোশাক খাতে বড় কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না।”

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “বাংলাদেশ যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাবে, এটা নিয়ে গত পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন পর্যায়ের স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে সরকার কথা বলেছে। কী করতে যাচ্ছে তার পরিকল্পনাও প্রকাশ হয়েছে। পোশাক শিল্পের মালিকরাও সেটা জানেন, তাদের প্রস্তুতিও আছে। কেউ যদি বলেন জানেন না সেটা ঠিক নয়।”

দেশের সামগ্রিক পণ্য রপ্তানির মধ্যে ৮৪ শতাংশই তৈরি পোশাক খাতের দখলে। ফলে এই খাতের উদ্যোক্তারা নগদ সহায়তার বড় অংশ পান। তবে সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে প্রায় ৫৬ শতাংশ পোশাক রপ্তানিতে নগদ সহায়তা পাওয়া যাবে না বলে জানান বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারা।

তারা বলছেন, রপ্তানির ক্রয়াদেশ নেওয়ার সময় ভর্তুকিসহ হিসাব করে পণ্যের দর নির্ধারণ করা হয়। ফলে পূর্ব ঘোষণা ছাড়া সরকার মাঝপথে এসে এভাবে হঠাৎ ভর্তুকি তুলে নেওয়া ও কমানোর কারণে তাদের বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, “যে পাঁচটি এইচএস কোডের পোশাক নগদ সহায়তা পাবে না বলা হয়েছে, সেগুলো থেকেই গত অর্থবছরে আমাদের ৫৬ শতাংশ রপ্তানি হয়েছে। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। শ্রমিকের মজুরিও বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ নগদ সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্ত আমাদের রপ্তানিকারকদের বড় রকমের অসুবিধায় ফেলবে।”

Link copied!