• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫
শাঁখারীবাজারে বেচাকেনার ধুম

দুর্গাপূজা ঘিরে পুরান ঢাকায় সাজসাজ রব


সোহানুর রহমান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০২৩, ১০:৩৪ এএম
দুর্গাপূজা ঘিরে পুরান ঢাকায় সাজসাজ রব
পুরান ঢাকার একটি মণ্ডপে চলছে প্রতিমা তৈরির কাজ। ছবি-সংবাদ প্রকাশ

প্রকৃতিতে শরতের শুভ্রতার সঙ্গে আসছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। শিশির ভেজা ভোর আর শরতের কাশফুল জানান দিচ্ছে শারদীয় দুর্গোৎসবের আগমনী বার্তা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্যই দেবী দুর্গার স্বর্গ থেকে আগমন ঘটেছিল মর্ত্যলোকে। এরই ধারাবাহিকতায় হিন্দুধর্মাবলম্বীরা প্রতিবছর শারদীয় উৎসব হিসেবে দুর্গাপূজা উদ্‌যাপন করে থাকে। দুর্গাপূজাকে ঘিরে রাজধানীর পুরান ঢাকায় চলছে সাজসাজ রব। এখানকার মণ্ডপগুলোতে প্রতিমা তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগরেরা।

রাজধানীর পুরান ঢাকায় সবচেয়ে বেশি পূজা উদযাপিত হয়। শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, শ্যামবাজার, প্যারীদাস রোড, কলতাবাজার, মুরগিটোলা, মদনমোহন দাস লেন, বাংলাবাজার গোয়ারনগর, জমিদারবাড়ি, গেন্ডারিয়া, ডালপট্টি এলাকার অলিতে গলিতে চলছে পূজা উদযাপনের আয়োজন। ছোট-বড় বিভিন্ন রকমের পূজামণ্ডপে শুরু হয়েছে মঞ্চ, প্যান্ডেল, তোরণ ও প্রতিমা নির্মাণের কাজ। বেশ ব্যস্ত সময় পার করছেন মৃৎশিল্পী থেকে শুরু করে কর্মচারী আর পূজা কমিটির সদস্যরাও।

দুর্গোৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ হলো দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরির কাজ। মৃৎশিল্পীদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় মাটির মূর্তিগুলো হয়ে উঠছে অপরূপ। খড় আর কাদা মাটি দিয়ে প্রতিমা তৈরি শেষে এখন চলছে মূর্তির ওপর প্রলেপ ও রঙ আর সাজসজ্জার কাজ। নিপুন হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে দেবী দূর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, অসুরসহ বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি। দেবী দুর্গা ও তার বাহন সিংহের প্রতিমাসহ তৈরি করা হচ্ছে যাকে বধের জন্য দেবীর আগমন সেই মহিষাসুরের প্রতিমা। এ ছাড়া তৈরি হচ্ছে দেবী লক্ষ্মী, সরস্বতী, দেবতা কার্তিক, গণেশ, এবং তাদের বাহন পেঁচা, হাঁস, ইঁদুর আর ময়ূর।

শাঁখারিবাজারের সঙ্ঘমিত্র পূজা কমিটির মণ্ডপে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরি করা মানিকগঞ্জের সুকুমার পাল জানান, এবারের দুর্গোৎসব উপলক্ষে তার মোট ৭টি প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে। সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৪ লাখ টাকায় তিনি প্রতিমা তৈরি করছেন।

শাঁখারিবাজার প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের পূজা মণ্ডপের প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত মৃৎশিল্পী বলাই পাল। তিনি বলেন, “এখনই বছরের সব থেকে বেশি ব্যস্ত সময় পার করছি। পূজার আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। তাই দম ফেলার সময়টুকুও আর নেই। এই সময়ের মধ্যেই দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরির সব কাজ শেষ করতে হবে। তবে প্রতীমা তৈরির ব্যয় বাড়লেও শিল্পীদের পারিশ্রমিক বাড়েনি।”

কাজ শেষে বিশ্রামের ফাঁকে প্রতিমা শিল্পী পল্টন পাল বলেন, “যত কষ্টই করি না কেন, যখন দেবীকে তার স্বরূপে মণ্ডপে বসানো হবে তখন সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে যখন আমাদের তৈরি করা প্রতিমাকে সবাই পূজা করে। তখন নিজেকে সফল ও সার্থক মনে হয়।”

দুর্গাপূজার আয়োজন নিয়ে শিব মন্দীর পূজা কমিটির সভাপতি দেবব্রত ঘোষ গগণ বলেন, “পূজায় সর্বস্তরের মানুষের সমাগম ঘটবে। এটা যেমন হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব তেমনি এতে অন্য ধর্মের বিপুলসংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করে। এজন্য সকলের কথা মাথায় রেখে সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।”

এদিকে দুর্গোৎসবের আগেই শাঁখারীবাজারের অলিগলিতে ক্রেতা-বিক্রেতাদের তুমুল ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। প্রতিমার সাজসজ্জা থেকে শুরু করে মুকুট, শাড়ি, অলংকার, লেস, সিঁদুর, ফুলের মালা, প্রতীকী অস্ত্র ও ঘট কেনা বেচায় ব্যস্ত সময় পার করছেন ক্রেতা বিক্রেতারা। প্রতিমার সাজপোশাক, জরি-চুমকিসহ মাঙ্গলিক সামগ্রী বিক্রির ধুম পড়েছে শাঁখারীবাজারের দোকানগুলোতে। পূজা-অর্চনার সব উপকরণই মেলে এই শাঁখারীবাজারে। এসব উপকরণ কিনতে অনেকে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন এখানে। তাই পূজার কেনাকাটার সবচেয়ে বড় বাজার পুরাতন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শাঁখারীবাজারে নেমেছে মানুষের ঢল। সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত চলছে বিকিকিনি, ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন ক্রেতা বিক্রেতারা। পূজার জন্য প্রায় ১০০ উপকরণের প্রয়োজন হয়। শাঁখারীবাজার থেকেই এসব উপকরণ সংগ্রহ করা যায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শাঁখারীবাজার থেকে এসব উপকরণ সংগ্রহ করেন। তবে ভারতীয় শাঁখার আমদানি বাড়ায় দেশীয় কারিগরদের হাতের তৈরি শাঁখার কদর কমছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

শাঁখারীবাজারের দোকানী শ্রী দেব বলেন, “রাঁধা কৃষ্ণ ও শিব এর প্রতিমা বেশি কিনছেন ভক্তরা। বাসাবাড়ির জন্য এগুলো নিচ্ছেন তারা। ভিড় বেড়েছে এখানকার শাঁখার দোকানগুলোতেও। সারা বছর শাঁখা পরলেও দুর্গাপূজার সময় নতুন শাঁখার অনেকটা চাহিদা থাকে। এ বছর চিকন শাঁখার চাহিদা একটু বেশি। তবে ক্রেতার ভিড় থাকলেও লাভ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছি।”

অর্পনা সরকার অপু নামের এক ক্রেতা বলেন, “চন্দন কিনেছি, লেস কিনব আবার মালাও কিনব। তিলকচন্দন আর মালা মুকুট আছে, এসবই কেনা হবে। গতবার ভালোভাবে কেনাকাটা করতে পারিনি। ছেলেমেয়েদের জন্য কেনাকাটা করেছি। মোটামুটি কম দামেই জিনিসপত্র পেয়েছি।”

কেনাকেটা করতে ময়মনসিংহ থেকে এসেছেন বিধান চক্রবর্তী। তিনি বলেন, “পূজার মুকুট, পূজার শাড়ি, পূজার গয়না, পূজার চুড়া, শাড়িসুড়ি এইগুলা কিনতেছি। আমরা মালাসহ পূজার যা যা লাগে সবই মোটামুটি কিনতেছি। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকেই আমি এখানে পূজার সামগ্রী কেনাকাটা করতে আসি।”

রাজধানীতে পূজা উদযাপনের সার্বিক বিষয়ে মহানগর সর্বজনীন পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি মনীন্দ্র কুমার নাথ বলেন, “এ বছর ঢাকা মহানগরে মোট ২৪৬টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা উদযাপন করা হবে। এর মধ্যে পুরান ঢাকার কোতোয়ালি, সূত্রাপুর ও বংশাল থানায় মোট ৫০টি পূজা মণ্ডপ রয়েছে। এছাড়াও ওয়ারীতে ১৮টি, গেন্ডারিয়ায় ১৪টি, হাজারীবাগ ও তুরাগে ১৩টি করে এবং বাড্ডায় ১০টি মণ্ডপসহ বাকি থানাগুলোতে দুর্গাপূজা উদযাপন করা হবে।”

তিনি আরও জানান, দুর্গোৎসবকে ঘিরে নিরবিচ্ছিন্ন নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শান্তিপূর্ণভাবে এই উৎসব সম্পন্ন করতে নেওয়া হয়েছে কড়া নিরাপত্তা। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যেকোনো ধরনের নাশকতা ঠেকাতে নেওয়া হচ্ছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এরই মধ্যে মণ্ডপে মণ্ডপে বসানো হচ্ছে সিসি ক্যামেরা। বৃষ্টি থেকে প্রতিমা বাঁচাতে প্রায় সবগুলো মণ্ডপে ত্রিপলের ছাউনি তৈরি করা হয়েছে।

নির্বিঘ্নে পূজা উদযাপনের লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শাহীনুর রহমান। তিনি বলেন, “আমাদের পক্ষ থেকে শতভাগ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোবাইল টিম এখন থেকেই কাজ করছে। আমরা পূজা উদযাপন কমিটির নেতাদের সঙ্গে ইতোমধ্যে মিটিং করে কীভাবে নির্বিঘ্নে নিরাপত্তার মাধ্যমে আমরা পূজা সমাপ্ত করতে পারব, সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”

দুর্গাপূজায় মণ্ডপে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বংশাল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মজিবুর রহমান বলেন, “এ ব্যাপারে আমাদের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি রয়েছে। আমার থানায় মাত্র দুটো পূজা তাও এক ছাদের নিচেই। তবু কাউন্সিলর ও পঞ্চায়েতের মাধ্যমে পূজার সমন্বয়ক কমিটি করা হয়েছে। তারা সার্বক্ষণিক দেখাশুনা করবে। আর ভলেন্টিয়াররা তো আছেই। সিসিটিভি ক্যামেরাও রয়েছে।”

সূত্রাপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মইনুল ইসলাম বলেন, “দুর্গাপূজায় আমাদের সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি মণ্ডপে আমাদের একজন অফিসার থাকবে। পূজা উদযাপন কমিটি ভলেন্টিয়ার টিমসহ হিন্দু মুসলিম মিলে সম্প্রীতি টিম গঠন করা হয়েছে। এখনো মণ্ডপগুলোতে প্রতিমা তোলা হয়নি। তবে অবশ্যই সিসি ক্যামেরা রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।”

মণ্ডপে বিচ্ছিন্ন ঘটনা এড়াতে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “এবার প্রতিটি মণ্ডপে আমরা নির্দিষ্ট সংখ্যক আনসার সদস্যও রাখব। যা করোনাকালীন সময়ে সীমিত পরিসরে পূজা হওয়ায় ছিল না। একটি মণ্ডপের জন্য একজন পুলিশ অফিসার নির্ধারণ করা আছে এবং তার অধীনে পুলিশ টিম থাকবে।”

জাতীয় বিভাগের আরো খবর

Link copied!