• ঢাকা
  • শনিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ২৫ মাঘ ১৪৩০, ১০ শা'বান ১৪৪৬

সিটি নির্বাচনে বিতর্কিতদের প্রার্থী করে ঝুঁকি নেবে না আ.লীগ


সফিকুল ইসলাম
প্রকাশিত: এপ্রিল ৩, ২০২৩, ০৯:৫৬ পিএম
সিটি নির্বাচনে বিতর্কিতদের প্রার্থী করে ঝুঁকি নেবে না আ.লীগ

পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিতর্কিতদের প্রার্থী করে ঝুঁকি নেবে না টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগ। প্রার্থীদের তালিকায় ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও দখলবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িত আছে এমন কাউকে সিটি নির্বাচনে নৌকার মনোনয়নও দেবে না দলটি। শুধু তাই নয়, ওইসব বিতর্কিত ব্যক্তিদের কোনো প্রার্থীর পক্ষে জোরালো প্রচার-প্রচারণাও চালাতে পারবে না। তাতে নৌকার প্রার্থী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ হতে পারে। ভূমিদস্যু-ওসন্ত্রাসীরা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামলে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরাও তাদের পক্ষে ভোট না দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিরোধীদলীয় শক্তিশালী প্রার্থীর কাছে গো-হারা হেরে যাবে। তাই আসন্ন পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিতর্কিত ও অপরাধ-দুর্নীতির সম্পৃক্ততা আছে তাদের দুরে রাখবে আওয়ামী লীগ। তবে সিটি নির্বাচন ঘিরে ইতোমধ্যে ব্যাপক তৎপরতা ও প্রস্তুতি চলছে আওয়ামী লীগে। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস পাওয়া গেছে।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে বিতর্ক ছাড়া নৌকাকে বিজয়ী করাই তাদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করতে সর্বাত্মক কাজ এখন থেকেই শুরু করতে দলটির স্থানীয় পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসবের লক্ষ্য, উৎসবমুখর পরিবেশ ও কেন্দ্রে ভোটারের সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিশ্চিত করা।

সম্প্রতি রাজধানীতে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “আগামীতে সিটি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্লিন ইমেজ ও জনপ্রিয়তা দেখে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যারা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য বিতর্কিত হয়েছে, আমরা এমন কাউকে মনোনয়ন দেব না। বিতর্কের ঊর্ধ্বে যারা আছে, যাদের কোনো অপকর্মের রেকর্ড নেই, তাদের আমরা চয়েজ করব।”

কাদের আরও বলেন, “জনগণের কাছে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য- এ ধরনের প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার জন্য আমাদের বোর্ড বসবে। সর্বাত্মকভাবে আমাদের নেত্রীরও ইচ্ছা ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া।”

সোমবার (৩ এপ্রিল) নির্বাচন কমিশন পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী, আগামী আগামী ২৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন, রাজশাহী ও সিলেটে ২১ জুন, খুলনা ও বরিশালে ১২ জুন ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

এই পাঁচ সিটি করপোরেশনের মধ্যে সিলেটে বিএনপির প্রার্থীর আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাকি চারটিকে নৌকা প্রতীকে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই পাঁচ সিটির নির্বাচন নিয়ে রাজনীতিতে শোরগোল পড়েছে। বলা হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আয়োজন জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি নির্বাচনী আবহ তৈরি করবে। কিন্তু মাঠের অন্যতম বিরোধী দল বিএনপি এখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন করছে। তারা (বিএনপি) ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি আর কোনো নির্বাচন করবে না। এমনকি আসন্ন পাঁচ সিটি নির্বাচনও বিএনপি বর্জন করবে বলে দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

যদিও বিএনপির অনেক নেতাই এখন এ সমস্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে। তফসিল ঘোষিত পাঁচ সিটি নির্বাচনকে কৌশলের খেলা হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, “জাতীয় নির্বাচনের আগে এই পাঁচ সিটি নির্বাচন হলো রাজনৈতিক কৌশলের খেলা। বিএনপি বলছে, তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এখন বিএনপি যদি এই সমস্ত নির্বাচনকে অকার্যকর এবং ভোটারবিহীন করতে পারে তাহলে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে আবার একটি বড় প্রশ্ন তৈরি হবে। ফলে পরিস্থিতি বিএনপিকে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করতে উৎসাহিত করবে। আর তারা যদি জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেয় তাহলে সেই নির্বাচন কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে তা নিয়ে আরেক প্রশ্ন উঠবে। তবে আওয়ামী লীগ যদি বিএনপিকে ছাড়াই এ সমস্ত নির্বাচনকে তাৎপর্যপূর্ণ, প্রতিযোগিতামূলক এবং অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে পারে তখন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে। তখন তারা মনে করবে যে বিএনপিকে বাদ দিয়েও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং সুষ্ঠু হয়। সুতরাং সিটি নির্বাচনগুলো হল জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি রিয়াসেল।”

এদিকে বিএনপি এবার রোজার মাসেও কর্মসূচি করছে। তারা বলছে যে তারা সরকারের পতন ঘটাতে প্রস্তুত। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও মাঠে আছে। আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে এবং সেটি অনেকাংশে দৃশ্যমান। এরকম পরিস্থিতি আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কি হবে? এই নির্বাচনে কী চমক থাকবে? ইত্যাদি প্রশ্ন এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের এই নির্বাচনকে গুরুত্ব দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। তাই প্রার্থিতা নিয়ে দলটি ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। সিটি নির্বাচনে কোনো ধরনের বিতর্কিত অথবা জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য এবং অতীতে দায়িত্ব পালনকালে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত কাউকে মনোনয়ন দেওয়া হবে না। ইতোমধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করায় গাজীপুরের (সাময়িক বরখাস্ত) মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তিনি মাফ পেলেও মনোনয়ন নিয়ে দোটানা আছে। জাহাঙ্গীর আলমকে আবারও নৌকা দেওয়া হতে পারে, এমন আলোচনা এরই মধ্যে গাজীপুরে শুরু হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির এক নেতা বলেন, “জাহাঙ্গীর আলম দলের প্রভাবশালী এক নেতার অনুগত। ওই নেতার কারণে তাকে সাধারণ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। এখন তিনি আবার জাহাঙ্গীর আলমকে মেয়র পদে প্রার্থী করতে তৎপরতা শুরু করেছেন। জাহাঙ্গীর গাজীপুরের জন্য অপরিহার্য, এমনটা দলের শীর্ষ নেতাদের বোঝাতে চেষ্টা করছেন তিনি।”

রাজশাহীর বর্তমান মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। তিনি আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে চান। তবে রাজশাহীর দৃশ্যমান উন্নয়ন করায় আবারও তিনি মেয়র পদে নৌকার প্রার্থী হতে পারেন বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা।

এদিকে রাজশাহীতে লিটনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার ও রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ। গত ২৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জনসভা করে আওয়ামী লীগ। আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে অনুষ্ঠিত ওই জনসভার মঞ্চে জায়গা দেওয়া হয়নি আসাদুজ্জামান আসাদকে। আসাদকে না দেখে শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। পরে তার নির্দেশে আসাদকে মঞ্চে ডাকা হয়। মেয়র পদে মনোনয়নের ক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনা হতে পারে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা।

খুলনায় মেয়র প্রার্থী হিসেবে তালুকদার আবদুল খালেকের নাম গত বছরের জুলাই মাসেই ঘোষণা করেন স্থানীয় নেতারা। খালেককে আবারও বিজয়ী করতে কাজ শুরু করতে নেতা-কর্মীদের নির্দেশনা দেন খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর চাচাতো ভাই শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল। নেতা-কর্মীরা তার পক্ষে কাজও শুরু করেছেন। তালুকদার খালেক ছাড়া প্রকাশ্যে কারও নাম আলোচনায় না থাকায় এখানে পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই বলে মনে করা হচ্ছে।

পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার পরে সিলেটে তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দুটিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান বিজয়ী হয়েছিলেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন কামরান। এবার আওয়ামী লীগ আসনটি উদ্ধারে মরিয়া। কামরানের জীবদ্দশায় অনেকে প্রার্থী হতে চাইলেও দলের মনোনয়ন পাননি। কামরানের মৃত্যুর পর দলীয় মনোনয়ন চেয়েছেন অনেকে। এর মধ্যে আলোচনায় আছেন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ টি এম হাসান জেবুল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ, সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের ছেলে আরমান আহমদ শিপলু ও সহসভাপতি আবদুল খালিক।

আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী প্রায় দেড় মাস ধরে সিলেটে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সিলেট-২ আসনে প্রার্থী হতে তৎপর থাকলেও দলীয় মনোনয়ন জোটেনি। তবে বসে থাকেননি তিনি। জাতীয় সংসদ থেকে স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনে ছুটে এসেছেন দেশে। দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মাঠে সরব থাকতে দেখা গেছে তাকে।

বরিশালে বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ আবারও মনোনয়ন পেতে পারেন। কেন্দ্র থেকে ইতোমধ্যে সেই সংকেত দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সেখানে তার বিকল্প হিসেবে কাউকে প্রকাশ্যে মনোনয়ন চাইতেও দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী ও মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, “মানুষ যাকে ভালো জানে এবং ভালোবাসে এই ধরনের নেতাকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করা হবে।”

একই কথা জানিয়েছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ আরও কয়েকজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা।

Link copied!