টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। এই মেয়াদে দেশজুড়ে একের পর এক উন্নয়নমূল কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় এবার উন্নয়নের ছোঁয়ায় নবরূপ পেতে যাচ্ছে কক্সবাজার। স্মার্ট বাংলাদেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে আগেভাগেই নবরূপে গড়ে তোলা হচ্ছে এ নগরীকে। চোখ-ধাঁধানো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দেবে। এ ছাড়া অর্থনীতিতে উজ্জ্বল আলোর মতো জ্যোতি ছড়াবে এসব প্রকল্প।
কক্সবাজারজুড়ে সরকারের নেওয়া উন্নয়ন মহাযজ্ঞের কাজ দ্রুতই শেষ হতে চলছে। মেগা প্রকল্পের আমূল পরিবর্তন এনে দেবে কক্সবাজার জেলার। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে জাতীয় অর্থনীতির একটি বড় অংশ কক্সবাজারের আয় থেকে জোগান হবে।
সরজমিনে দেখা গেছে, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়। সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনও করা হবে বেশিরভাগ প্রকল্পের। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। জেলা প্রশাসনও কাজগুলোর তদারকি করছে। কক্সবাজারকে কেন্দ্র করে সরকারে নেওয়া মেগা প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক কক্সবাজার, সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র, মেরিন অ্যাকুরিয়াম স্থাপন, ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপ লাইন, মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, দোহাজারি থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ, আইকনিক স্টেশন এবং রামু থেকে মিয়ানমারের নিকটে গুনদুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ, মাতারবাড়ী ২৬০০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপারক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট, কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প।
জানা গেছে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকার পর সবচে বেশি মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে কক্সবাজারে। ২০০৮ সালের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকেই কক্সবাজারে ধারাবাহিক উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে।
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর
দেশের সর্বপ্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর মাতারবাড়ীর অবস্থান মহেশখালীতে। জাপানের দুইটি ব্যস্ততম বন্দর নিগাতা এবং কাশিমারর আদলে নির্মাণ করা হচ্ছে এই বন্দরটি। জাপানি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা এই বন্দর নির্মাণের চুক্তি পেয়েছে।
ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট
বঙ্গোপসাগরে বিস্তৃত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে বাংলাদেশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। বঙ্গোপসাগরের অপার সম্ভাবনা ও সম্পদ চিহ্নিতকরণ, পরিমাণ নির্ধারণ ও জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথাযথভাবে ব্যবহারসহ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, আবহাওয়ার পরিবর্তন ও দূষণ ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণার জন্যই সরকার ‘বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেছে।
সাফারি পার্ক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক কক্সবাজার সম্পর্কে বলা হয়, ১৯৮২ সালে অবিভক্ত কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলাধীন ডুলাহাজারা ব্লকের ৪২ দশমিক ৫ হেক্টর বনাঞ্চল নিয়ে একটি হরিণ প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। পরে ২০০১ সালে উঁচু-নিচু টিলাসমৃদ্ধ চিরসবুজ এ বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও আবাসস্থলের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে এর আয়তন ৩ হাজার হেক্টর বৃদ্ধি করে দেশের প্রথম সাফারি পার্ক হিসেবে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক কক্সবাজার’র যাত্রা শুরু হয়।
এসপিএম
ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপ লাইন প্রকল্প বিষয়ে জেলা প্রশাসন জানায়, দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি তেলের চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ এবং জ্বালানি নিরাপত্তা অধিকতর নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল ও ফিনিসড প্রডাক্ট দ্রুত, ব্যয়সাশ্রয়ী, সুষ্ঠু, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে খালাস করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার ‘ইন্সটলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে জি-টু-জি ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ/বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) পক্ষে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
বন্দর সড়ক উন্নয়ন
মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের (সওজ অংশ) অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ও অন্যান্য প্রভাব সম্পর্কে জানানো হয়, চট্টগ্রাম বিভাগের মাতারবাড়ী, মহেশখালী ও চকরিয়া এলাকাগুলোকে নিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ের (এন-১) সঙ্গে বন্দর সংযোগ নির্মাণের মাধ্যমে টেকসই ও নিরাপদ আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
প্রশস্ত সড়ক এবং নতুন সেতু নির্মাণের মাধ্যমে সড়ক ব্যবহারকারীদের খরচ হ্রাস করতে সহায়তা করবে। এতে সামাজিক ও অন্যান্য প্রভাব সম্পর্কে বলা হয়, এই এলাকায় একটি লজিস্টিক পার্ক, পাওয়ার প্ল্যান্ট, এলএনজি টার্মিনাল ইত্যাদিসহ একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার মাধ্যমে স্থানীয় জনগণের পুনর্বাসন এবং কর্মসংস্থান তৈরিতে সহায়তা করবে। একটি নতুন সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ফলে মালবাহী পরিবহন তৈরি হবে যা আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রমসহ দেশের অন্যান্য অংশে নিয়ে যাওয়া সহজতর হবে।
রেলপথ
দেশের ইতিহাসে প্রথম রেলপথে যুক্ত হচ্ছে কক্সবাজার। চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার যাবে রেল। কক্সবাজারে ঝিনুকের আদলে গড়ে তোলা হচ্ছে দেশের একমাত্র আইকনিক স্টেশন। এ ছাড়া রামু থেকে মিয়ানমারের নিকটে গুনদুম পর্যন্ত প্রকল্পের প্রভাব বিষয়ে জানানো হয়, দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের যাতায়াত সুবিধা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। প্রস্তাবিত ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে করিডোরের গুরুত্বপূর্ণ রেল-নেটওয়ার্ক হিসেবে বিবেচিত হবে, যা রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান এই রেলপথটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে।
খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প
খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প সম্পর্কে জেলা প্রশাসন জানায়, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ও জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের নিত্যনৈমিত্তিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা মানুষের জীবন ও সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে থাকে। বাংলাদেশের মানুষ প্রতি বছর এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তাদের সহায় সম্পত্তি হারিয়ে ফেলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের ভূমিহীন-গৃহহীন-ছিন্নমূল অসহায় মানুষের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীন-গৃহহীন-ছিন্নমূল-অসহায় মানুষের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রহণ করেন। তারই অংশ হিসেবে কক্সবাজার জেলার জলবায়ু উদ্বাস্তু ভূমিহীন-গৃহহীন-ছিন্নমূল অসহায় মানুষের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ‘খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প’ গ্রহণ করা হয়। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আক্রান্ত উপকূলীয় অঞ্চল কক্সবাজারের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ৫ তলাবিশিষ্ট ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করে ৪ হাজার ৪০৯টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে এবং পুনর্বাসিত পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করা হবে। প্রকল্পটি বিশ্বের বৃহত্তম জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প হিসেবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
উন্নয়ন প্রকল্পের বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, সরকারের নেওয়া নানান উন্নয়নমূলক প্রকল্প বদলে দিয়েছে পুরো কক্সবাজারকে। সবচেয়ে বেশি মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে রাজধানী ঢাকায়। এরপরই নেওয়া হয়েছে কক্সবাজারে। প্রকল্পগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে কক্সবাজার হবে একটি উন্নত ও পরিপূর্ণ পর্যটন নগর।