সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় ৮টি ধারায় অপরাধের সংজ্ঞা ও এই আইনের প্রক্রিয়া আরও সুস্পষ্ট করার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)।
মঙ্গলবার (৫ সেপ্টেম্বর) আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে বিএফইউজের পক্ষে এ প্রস্তাব করেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল। জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন বিষয়ে বিএফইউজের উপস্থাপনা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় লিখিতভাবে এ পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
৮টি ধারা নিয়ে বিএফইউজের পর্যবেক্ষণ
৮ নম্বর ধারায় উপধারা ২: যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট প্রতীয়মান হয় ... ‘প্রতীয়মান’ শব্দটি বিপজ্জনক। আইনি প্রক্রিয়ায় কোনো অভিযোগ প্রাপ্তি, তদন্ত বা প্রমাণের আগেই শুধু ‘প্রতীয়মান’ হওয়ার ভিত্তিতে অবারিত ক্ষমতার প্রয়োগ রাখার বিধান বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।
২১ নম্বর ধারা: মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণার দণ্ড। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি সংজ্ঞায় স্পষ্ট করা হয়েছে। জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার ক্ষেত্রে ‘বিরুদ্ধে’-এর পরিবর্তে আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা উচিত বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণা চালানো হবে অপরাধ। এসব অভিযোগ এবং এসবের প্রতি সমর্থনের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান থাকতে হবে।
২৫ নম্বর ধারা: আক্রমণাত্মক, মিথ্যা ও ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ প্রকাশ ইত্যাদি। আরও সুনির্দিষ্ট করা দরকার বা এ ধারাটি বাতিল করা দরকার। রাজনৈতিক বক্তৃতা তো আক্রমণাত্মক হয়, কোনো মালিক বেতন ভাতা না দিলে তার অফিস ঘেরাও করে ভুক্তভোগী শ্রমিক-কর্মচারীরা যে আন্দোলন করে, সেখানে এইসব উপাদান তো থাকবেই। এসবই কি অপরাধ বলে বিবেচিত হবে?
২৮ নং নম্বর ধারা: ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত প্রসঙ্গ। এটা আরও সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। ধরা যাক, দুই পিরের বা মাজারের সমর্থক দুই গ্রুপ পরস্পরের পির বা বিশ্বাসের প্রতি আক্রমণ করে বক্তব্য দিলো, এটি নিয়ে অভিযোগ আনা হলে এ বিতর্কের অবসান হবে কীভাবে? যেমন সনাতন ধর্ম সংস্কার নিয়ে একপক্ষ কাজ করছে, প্রকাশ্যেই আলোচনা চলছে, আবার অপরপক্ষ মনে করে এটা সনাতন ধর্মের প্রতি আঘাত। এ নিয়ে কোনো মামলা কি এ আইনের আওতায় আসবে?
২৯ নম্বর ধারা: মানহানিকর তথ্য প্রকাশ। এ বিষয়ে দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৪৫ ধারার ৪৯৯ সেকশনে যেহেতু স্পষ্টীকরণ করা আছে, সেহেতু এ ধারা নতুন করে সাইবার নিরাপত্তা আইনের আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি না।
৩১ নম্বর ধারা: আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো। এ ধারাটি এতই ব্যাপক যে রাজনীতি ও পেশাজীবী আন্দোলনের যেকোনো কর্মসূচি পালনের পর যে কাউকে এ ধারায় অপরাধী সাব্যস্ত করা যাবে। ‘ঘটনা ঘটায় বা ঘটিবার উপক্রম হয়’, বিষয়টি এতটা অস্পষ্ট এবং প্রয়োগের ক্ষমতা এতটা ব্যাপক যে একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করবে।
৩২ নম্বর ধারা: অফিসিয়াল সিক্রেটস আইনকে নতুন জীবন দেওয়ার বিরুদ্ধে আমরা। এ ধারা পুরোটা বাতিলের দাবি জানাচ্ছে সাংবাদিক সমাজ।
৪২ নম্বর ধারা: পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তার। এ ধারায় উপপরিদর্শকের নিচে নয় এমন পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তাকে পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতোই রাখা হয়েছে। এটিই হচ্ছে আইনটির মিস ইউজ ও অ্যাবিউজের মূল শক্তি।
মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, “এ ধারাটি অক্ষুণ্ণ রেখে আইনের অপব্যবহার হবে না বিষয়টি কোনোভাবেই নিশ্চিত করা যাবে না। সংবাদকর্মীরা এর খপ্পরে আগেও যেমন পড়েছেন, এবারও রেহাই মিলবে না। আমাদের সুস্পষ্ট প্রস্তাব, সাংবাদিকদের বেলায় এ ধারা রহিত করতে হবে। কোনোভাবেই এ ধারায় সাংবাদিক বা সংবাদকর্মীকে পেশাগত কোনো কাজের জন্য গ্রেপ্তার করা যাবে না। কোনো কাজে আপত্তি থাকলে সমন জারি করে আদালতে হাজির হতে বলা যাবে।”
আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএফইউজের সভাপতি ওমর ফারুক। বিএফইউজের মহাসচিব দ্বীপ আজাদের সঞ্চালনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব আব্দুল জলিল ভূঁইয়া, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ, বর্তমান সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন।