পবিত্র কোরআন আল্লাহ তায়ালার এক অপার বিস্ময়। তিনি অনন্তকাল এই গ্রন্থকে সংরক্ষণের ঘোষণা দিয়েছেন। সুরা হিজরের ৯ নম্বর আয়াতে তিনি ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আমি কোরআন নাজিল করেছি, এবং আমিই তার সংরক্ষণকারী।’
কোরআন সংরক্ষণের অন্যতম একটি মাধ্যম এর তিলাওয়াত জারি রাখা। আল্লাহ তায়ালা বিগত দেড় হাজার বছর ধরে এ জন্য তাঁর কিছু বান্দাকে নিয়োজিত রেখেছেন। ঘূর্ণয়মান এই পৃথিবীতে এমন কোনও মুহূর্ত নেই, যে সময়টাতে পবিত্র কোরআনের তিলাওয়াত হয় না।
এটা তো গেলো সামগ্রিক অবস্থা, কিন্তু পৃথিবীতে এমন একাধিক একক জায়গাও আছে, যেখানে শত শত বছর ধরে অনবরত পবিত্র কোরআনের তিলাওয়াত চলছে। সেগুলোরই অন্যতম তুরস্কের তোপকাপি প্রাসাদ।
দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় ঐতিহাসিক শহর ইস্তাম্বুলে এটির অবস্থান। এই প্রসাদের করিডোরে বিগত ৫০০ বছর ধরে অনবরতভাবে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত জারি রয়েছে। এই ইতিহাসের শুরু হয়েছিল উসমানীয় সুলতান প্রথম সেলিমের শাসনামল (শাসনকাল: ১৫১২-১৫২০) থেকে।
বয়সের ভারে তোপকাপি প্রাসাদ আজ ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। কিন্তু তার জীর্ণতার মাঝেও কোরআনের সুর আজও সেখানে প্রাণবন্ত ও রূহানি আবহ ছড়িয়ে দিচ্ছে। তোপকাপির শুধু এই ঐতিহ্যই নয়; প্রশাসনিক ভবন ও সুলতানদের বাসস্থান থেকে বর্তমানে জাদুঘরে রূপান্তরিত হওয়া এই ভবনে সংরক্ষিত আছে মহানবী (সা.) ও ইসলামি ইতিহাসের নানা স্মৃতি।
তোপকাপি প্রাসাদ বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত একটি দর্শনীয় স্থান। প্রতিদিন এখানে অসংখ্য দর্শণার্থীর সমাগম হয়। তারা যখন এখানে আসেন, তখন তাদের স্বাগত জানায় পবিত্র কোরআনে সুমধুর সুর। যেই রূহানি সুর উসমানীয় যুগ হয়ে তাদের আত্মাকে বেঁধে দেয় রাসুল (সা.) এর সেই সোনালি সময়ের সঙ্গে।
তোপকাপিতে প্রবেশর পর পরই পর্যটকদের কানে কোরআনের তিলাওয়াত ভেসে আসে। প্রথমে তাদের মনে হয়, এটি হয়ত টেপ রেকর্ডারে বাজছে, কিন্তু যখন তারা স্বচক্ষে তিলাওয়াতকারীকে দেখেন, তখন তারা অবাক হন এবং মুগ্ধ হন দারুণ এ দৃশ্য অবলোকন করে।
যেভাবে ২৪ ঘণ্টা তিলাওয়াত চলে
প্রতিদিন মোট ২৮ জন কারী সাহেব এখানে পালাক্রমে কোরআন তিলাওয়াত করেন। তারা একেকজন ৪৫-৬০ মিনিট পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে তিলাওয়াত করতে থাকেন; একজন উঠলে তার স্থলে তিলাওয়াত শুরু করেন সিরিয়ালে থাকা আরেকজন। দৈনিক এখানে এক খতম তিলাওয়াত করা হয়। মানে বছরে ৩৬৫ খতম কোরআন পড়া হয় তোপকাপি প্রাসাদ জাদুঘরে।
রমজান মাসে এখানে এক বিশেষ ধরনের আমেজ পরিলক্ষিত হয়। কোরআন তিলাওয়াতের পাশাপাশি এ সময় পড়া হয় নানা দোয়া ও দরূদ। তিলাওয়াতকারী হাফেজদের জন্যও থাকে বিশেষ আয়োজন। এটিও চলে আসছে সেই উসমানীয় যুগ থেকেই।
১৫১৭ সালে সুলতান প্রথম সেলিম যখন মিসর থেকে ‘পবিত্র আমানত’ নিয়ে আসেন, তখন সেটি রাখা হয় তোপকাপি প্রসাদে। এ সময় তিনি উসমানীয় সালতানাতকে খেলাফত ঘোষণা করেন এবং তিনি নিজে এই খেলাফতের প্রথম খলিফা হন। এমন পরিস্থিতিতে তিনি নির্দেশ দেন– যেখানে আমানত রাখা হয়েছে, সেখানে অনবরত কোরআন তিলাওয়াত জারি থাকাই সমুচিৎ।
সেই থেকে তোপকাপি প্রাসাদটি এই চলমান ‘রূহানি আবর্তনের’ আবাসস্থল হয়ে উঠেছে, যেখানে নবীজী (সা.) এর চাদর, তাঁর তরবারি, তাঁর পবিত্র দাড়ি, উহুদের যুদ্ধে ভাঙা দাঁত, পবিত্র কাবার চাবি এবং সাহাবি ও তাবেঈনদের নানা স্মৃতি বিদ্যমান।
তোপকাপি প্রাসাদের ইসলামী প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ইলহান কোজামান বলেন, ‘এ স্থানটির পবিত্রতা এমন যে তা মদিনা মুনাওয়ারার মতোই মনে হয়। এখানে সংরক্ষিত আছে রাসুল (সা.) এর চাদর, তাঁর তরবারি এবং সেই সব পবিত্র আমানত, যেগুলোকে উসমানীয়রা অত্যন্ত যত্নসহকারে রক্ষা করতো।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিসর ও হিজাজ বিজয়ের পর সুলতান প্রথম সেলিম পবিত্র আমানতগুলো ইস্তাম্বুলে আনার নির্দেশ দেন এবং ৩৯ জন কোরআনের হাফেজ খুঁজে আনতে বলেন; যাতে তিনি নিজে হতে পারেন তাদের চল্লিশতমজন। সেই দিন থেকে এই মহিমান্বিত কক্ষে কোরআন তিলাওয়াত এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধ হয়নি।’
পবিত্র আমানতগুলোর প্রতি উসমানীয়দের যত্ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যখন তারা চাদরের স্থানটি পরিষ্কার করতো, তখন ধুলো বাইরে ফেলত না; বরং হুজুর পাক (সা.) এর প্রতি সম্মান দেখিয়ে তা বিশেষভাবে খনন করা একটি কূপে রেখে দিতো।
ইলহান কোজামান বলেন, ‘এই ধারাবাহিক আমলটি একটি আত্মিক ও রূহানি দায়িত্ব এবং এক পবিত্র উত্তরাধিকার। সুলতান প্রথম সেলিমের সময় থেকে আজ পর্যন্ত আমরা নিজেদের এই পবিত্র আমানতগুলোর রক্ষণাবেক্ষণকারী মনে করি।’
এই ধারাবাহিক তিলাওয়াতের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে কোরআনের সরাসরি তিলাওয়াত বজায় রাখি, যাতে উসমানীয় রূহ-চেতনা সবসময় এখানে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত থাকে।’
প্রাসাদে তিলাওয়াতকারী কারী খালিল ইবরাহিম অকগুন বলেন, ‘আমরা তিলাওয়াতের মাধ্যমে এই স্থানটিতে আমানতের খেদমত করে থাকি, যেখানে নবীজী (সা.) এর প্রতি সর্বোচ্চ মোহব্বত প্রকাশ পায়। কারণ, এখানে আমরা মুহাম্মদী প্রেমের অর্থ ও অনুভূতি পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারি ‘
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পাঁচ শতাব্দী ধরে চলমান এক ধারাবাহিক মালার একটি পুঁতি; যা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে আমরা গ্রহণ করেছি এবং আগামী প্রজন্মের কাছে তা পৌঁছে দিচ্ছি। এই মর্যাদাপূর্ণ স্থানে থাকা অসম্ভব ভালো লাগা এক বর্ণনাতীত নেয়ামত।’








































