কারও ‘মাথাব্যথা’, কারও ‘চোখের মণি’, কে এই খামেনি


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: জুন ১৯, ২০২৫, ০১:৫০ পিএম
কারও ‘মাথাব্যথা’, কারও ‘চোখের মণি’, কে এই খামেনি
আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। ছবি : সংগৃহীত

মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজন এখন তুঙ্গে। ‘অজেয় ও অপ্রতিরোধ্য’ ইসরায়েলের সব জায়গায় এখন বোমা ফেলছে ইরান, যা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছে। ইরান-ইসরায়েল সাম্প্রতিক উত্তেজনা শুরুর পর থেকেই যে নামটি সবচেয়ে বেশি আলোচনায়, তা হচ্ছে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে শুরু করে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু‑বিরোধী নেতারা সবাই ইরানের এই সর্বোচ্চ নেতাকে সরাসরি টার্গেট করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এমনকি তাকে ‘স্বৈরশাসক’ বলে অভিহিত করেছেন ইসরায়েলের মন্ত্রীরা।

আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি হলেন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তি। প্রায় চার দশক ধরে তিনি ইরানের ক্ষমতায়। এ সময়ে তিনি আমেরিকা ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন, ইরানের ‘আলোচিত’ পারমাণবিক কর্মসূচি এগিয়ে নিয়েছেন এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধ-আন্দোলন দমন করেছেন। ইরানে প্রেসিডেন্টের চেয়েও বেশি ক্ষমতা তাঁর। ইব্রাহিম রাইসি প্রেসিডেন্ট থাকার সময় যে ক্ষমতা ছিল, এখন মাসুদ পেজেশকিয়ানের সময়ও একই ক্ষমতা খামেনির। 

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে খামেনি ইরানের সরকার, বিচার বিভাগ, সামরিক বাহিনী, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) এবং কুদস ফোর্সের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখেন। তিনি ছিলেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির শিষ্য, যিনি ১৯৭৯ সালের ইরান বিপ্লবের মাধ্যমে দেশটির রাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

১৯৮১ সালে খামেনি বিরোধীদের হামলার শিকার হন, যাতে তাঁর ডান হাত স্থায়ীভাবে বিকল হয়ে যায়। রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর ১৯৮৯ সালে তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার পর থেকে খামেনি ইরানের সীমান্ত ছাড়িয়ে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে মনোযোগ দেন। ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’ নামে পরিচিত একাধিক মিত্রগোষ্ঠী গড়ে তোলেন, যা লেবানন থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃত। এ তালিকায় রয়েছে হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতি। 


খামেনির ক্ষমতার এই দীর্ঘ সময় ইরান সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও, সবকিছু বদলে যায় যখন ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালায়। এরপর গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন, লেবাননের হিজবুল্লাহর ওপর আক্রমণ এবং ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্র ও শীর্ষ সামরিক নেতাদের ওপর ইসরায়েলের বিমান হামলা ইরানের অজেয় ভাবমূর্তি ভেঙে দেয়।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন বলছে, আয়াতুল্লাহ কোনো নাম নয়, পদবি। ইরানের সুপ্রিম লিডার হলেন ‘আয়াতুল্লাহ’। আসলে ইরানে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী থাকলেও গোটা দেশ পরিচালনা করে শুরা কাউন্সিল। এই কাউন্সিলের সদস্য ১২ থেকে ২৫ জন ধর্মীয় নেতা। আর তাদের নেতৃত্বে থাকেন ‘আয়াতুল্লাহ’, যার ছাড়পত্র পেলে তবেই দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী কিংবা সেনাপ্রধান পদে মনোনয়ন পাওয়া যায়। তারপর হয় নির্বাচন। 

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ১৯৩৯ সালে ইরানের পবিত্র শহর মাশহাদ শহরে জন্ম হয় আলী খামেনির। ক্রমশ তৎকালীন সুপ্রিম লিডার আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির ছায়াসঙ্গী হয়ে ওঠেন তিনি। ইরানে তখন শাহ বংশের শাসন। এক সময় স্বজনপোষণ, দুর্নীতি, বিরোধীদের কণ্ঠস্বর দমনসহ একাধিক অভিযোগে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে ইরান। পথে নামে আমজনতা। শাহরা দেশ ছাড়েন ১৯৭৯ সালে, খোমেনিরা আসেন ক্ষমতায়।

সেই সময় থেকে শুধু ইরান নয়, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেন খামেনি। বিশেষত শিয়াদের মধ্যে। গত ৩৫ বছর ধরে পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার তৈরি থেকে শুরু করে আধুনিক সমরাস্ত্র ভান্ডার তৈরির কাজ সেরেছেন নিঃশব্দে। নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা উড়িয়ে আমেরিকার চোখে চোখ রেখে জবাব দিতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি তিনি।

এই সংঘাতে খামেনিকে শেষ করতে পারলে ইরানকে ফের অভিভাবকহীন করে দিতে পারবে পশ্চিমারা। সেই সুযোগে ‘তেলের খনি’র দেশে হাতের পুতুলকে ক্ষমতায় বসাতে পারবে আমেরিকা। আবার খামেনির পতন হলে, খেই হারাবে হিজবুল্লাহ, হামাস, হুতিরা। তাতে ইসরায়েল বেশ খুশিই হবে। ভয়ডরহীন হয়ে নিজের মতো সব কার্যক্রম চালাতে পারবেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

Link copied!