প্রাচীন যুগ থেকেই বাংলার একটি উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনাময় অর্থকরী ফসলের নাম লাক্ষা। নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার হয় এই লাক্ষা। কাঠের আসবাবপত্র ও পিতল বার্নিশ করা, স্বর্ণালংকারের ফাঁপা অংশ পূরণ করা, ঔষধের ক্যাপসুল, চকলেট ও চুইংগামের কোটিং তৈরি, লবণাক্ত পানি থেকে জাহাজের তলদেশ রক্ষা করা, লবণাক্ততায় নষ্ট হওয়া লোহা ঠিক করা, ডাকঘরের চিঠির সিলমোহর তৈরিতে, পুতুল-খেলনা ও টিস্যু পেপার তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয় লাক্ষা।
কিন্তু বর্তমানে হারিয়ে যাচ্ছে অর্থকরী ফসল লাক্ষার সোনালি দিন। একসময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেমিয়লাটা, বরই, বাবলা, কড়ই গাছের বাগান আকারে চাষ করা হতো। এখন নানা সংকটের কারণে তা চাষ করছেন না চাষিরা।
দেশের একমাত্র লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। সেটিও জনবলের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। একাধিক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার পদ থাকলেও একজন বিজ্ঞানী দ্বারা চলছে ২৪ একর জমির ওপর নির্মিত লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্র।
লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে লাক্ষা চাহিদা রয়েছে দশ হাজার মেট্রিক টন। তার বিপরীতে বর্তমানে দেশে লাক্ষা উৎপাদন হচ্ছে দুইশত মেট্রিক টন। যার ৭০ শতাংশ উৎপাদন হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। বাকিটা আমদানি করা হয় বিভিন্ন দেশ থেকে। এক সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার একাধিক স্থানে লাক্ষা চাষ করতেন কৃষকরা। বর্তমানে নানান সংকটের কারণে তা কমে গেছে।
এর কারণ হিসেবে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আম চাষ, ফসলে কীটনাশক-বালাইনাশক ব্যবহার, বিরূপ আবহাওয়ার কারণকে লাক্ষা চাষের অন্তরায় হিসেবে দেখছেন গবেষকরা। তাছাড়া লাক্ষা চাষের ওপর প্রশিক্ষণ ও পর্যাপ্ত দাম না পাওয়ায় লাক্ষা চাষ করছেন না চাষিরা।
জেলার বরেন্দ্র অঞ্চল নাচোল উপজেলায় বর্তমানে বেশি লাক্ষা চাষ হলেও দিন দিন চাষিদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। কেউ বাড়তি আয়ের আশায়, আবার কেউবা পৈত্রিক ব্যবসা ধরে রাখতে চাষ করেছেন লাক্ষা।
এ বিষয় নিয়ে কথা হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার মাক্তাপুর গ্রামের মো. সাদিকুল ইসলাম ও মো. ইসরাইল হকসহ কয়েক জন লাক্ষা চাষির সঙ্গে। তারা জানান, এই অঞ্চলে লাক্ষা চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে নানা সংকটে বড় আকারে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করতে পারছেন না তারা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এই লাক্ষা চাষ করা সম্ভব নয় বলেও জানান তারা।
পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত চাষিরা লাক্ষা চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। ফলে দিনে দিনে কমে যাচ্ছে লাক্ষা চাষ।
এদিকে বর্তমান লাক্ষার দুরবস্থা নিয়ে লাক্ষা গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, “লাক্ষা একটি লাভজনক ফসল। চাঁপাইনবাবগঞ্জে লাক্ষা চাষে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। জেলার সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলায় আম চাষ বেড়ে যাওয়ার কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে লাক্ষা চাষের চাহিদা বাড়লেও প্রতিনিয়ত লাক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন চাষিরা। এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্রে একাধিক বিজ্ঞানী পদ থাকলেও তিন বছর ধরে আমি একায় আছি। এতে চাষিদের পর্যাপ্ত সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।”