পাঁচ শিক্ষার্থীর ৫ বছরের মানবসেবা এলাকায় এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। টিফিনের টাকাই ছিল ওদের একমাত্র মূলধন। ওই মূলধনকে পুঁজি করে তারা মানবসেবার কর্মপরিকল্পনা করে। তাদের স্বল্প পুঁজিতে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী। শিক্ষকদের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী টিম গঠন করে। সেই টিমের নাম দেয়া হয় ‘শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠন’। এই সংগঠন বর্তমানে একটি জনকল্যাণমূলক সেবা প্রদানকারী সংগঠনে রূপ পেয়েছে।
২০১৬ সালের মার্চ মাসে শুরু হয় পাবনার বেড়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বিপিন বিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঁচজন শিক্ষার্থীর গল্প। এই পাঁচ বছরে তারা একে একে বাস্তবায়ন করেছে বেশকিছু কর্মসূচি। এই সময়ের মধ্যে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সংক্রান্ত সহায়তা থেকে শুরু করে এতিমখানায় খাদ্যের যোগান, দুস্থদের নানাভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। যেখানেই ওরা মানুষের অসহায়ত্বের খবর পাচ্ছে, সেখানেই ওরা পৌঁছে যাচ্ছে। খাদ্যসামগ্রী, চিকিৎসাসামগ্রী, শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে। নিজেদের জমানো টিফিনের টাকা ও বিত্তবানদের কাছ থেকে পাওয়া সহায়তা সংগঠনের মূল পুঁজি। বর্তমানে সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ১৫০ জনের মত।
আলাপকালে সংগঠনের সদস্যরা জানান, করোনাকালে সংগঠনের সদস্যরা গরীব মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে। অসহায় অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসায় সহায়তা করেছে। ওষুধের দোকানে রক্তচাপ মাপার যন্ত্র, ডায়াবেটিস মাপার যন্ত্র, থেরাপি ও নেবুলাইজার যন্ত্র কিনে দেওয়া হয়েছে। এসব ওষুধের দোকানে প্রকৃত দুস্থ রোগীরা বিনামূল্যে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করছেন, রক্তচাপ মাপাতে পারছেন।
অসহায় কারও ওষুধের প্রয়োজন হলে কিনে দেওয়া হচ্ছে। যমুনার চরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে শত শত মানুষের মাঝে করোনা টিকার রেজিস্ট্রেশন ও মাসব্যাপী ফ্রি বাজারের আয়োজন ছিল চোখে পড়ার মত। রমজান মাসের পুরো মাস এতিমখানাসহ বিভিন্ন রাস্তাঘাটে ইফতার সামগ্রী ও সেহরি বিতরণ করেছে। ঈদে দুস্থদের মাঝে পোশাক বিতরণ করেছে।
সাঁথিয়া উপজেলার পুন্ডুরিয়া ও আফরা গ্রামে দুটি মাদ্রাসা ও এতিমখানার জন্য দুটি আধপাকা ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে। এ কাজে অর্থ, টিন, ইট, বালু সিমেন্ট ইত্যাদি দিয়ে সহায়তা করেছেন দেশের বিভিন্ন এলাকার হৃদয়বান মানুষ। এখন নিয়মিত মাদ্রাসাগুলোতে খাবার পরিবেশন, বই খাতা, জামা কাপড় এমনকি এতিমদের হাত খরচও দিয়ে আসছে।
বন্যা কবলিত এলাকায় গিয়ে বাঁশের সাঁকো পর্যন্ত তৈরি করে দিচ্ছে এই সংগঠন। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরের সান্তশাহ এলাকায় প্রায় ৭ শতাধিক মানুষের চলাচলের জন্য দুইটি দীর্ঘ বাঁশের সাঁকো তৈরি করে দিয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় শতাধিক দরিদ্র নারীদের মধ্যে স্যানিটারি ন্যাপকিনও বিতরণ করেছে।
সান্তশাহ গ্রামের আব্দুর রহিম বলেন, “আমাদের এলাকার প্রায় আট শতাধিক মানুষ পানিবন্দী, ঠিকমত হাটেবাজারে যেতে পারি না। কোথাও যেতে হলে নৌকায় করে বেশি টাকা ভাড়া দিয়ে পারাপার হতে হয়। ত্রাণ সামগ্রী পাওয়া তো দুরের কথা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা খোঁজখবর পর্যন্ত নেয়নি। এর মাঝে শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠন আমাদের এলাকায় যাতায়াতের জন্য দুটি বাঁশের সাঁকো তৈরি করেছে।”
গৃহবধূ খাদিজা খাতুন বলেন, “বন্যা কবলিত আমাদের এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যেতে খুবই ভয় লাগে, বৃদ্ধ নারী-পুরুষ শিশুরা নৌকায় উঠে যেতে পারে না। বিশেষ করে একজন অসুস্থ হলে হাসপাতালে নেওয়া খুবই কষ্টদায়ক ব্যাপার। সবচেয়ে বড় সমস্যা নদী পারাপার। বাঁশের সাঁকো তৈরি হওয়ায় খুবই উপকার হয়েছে।”
বেড়া উপজেলার হাটুরিয়া জগন্নাথপুর এতিমখানা মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা সোহেল রানা বলেন, “এই সংগঠন এতিমখানা মাদ্রাসার ছাত্রদের পোশাক থেকে শুরু করে হাত খরচ পর্যন্ত দিয়ে থাকে। যেকোনো সমস্যায় আর্থিক সহযোগিতা করে।”
বেড়া কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র তরিকুল ইসলাম বলেন, “বন্যাকবলিত এই এলাকায় আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে দুটি বাঁশের সাঁকো তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানবসেবায় ছুটে যাচ্ছে সংগঠনের সদস্যরা।”
শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠনের সভাপতি মেহরাব হোসেন জিম বলেন, “টিফিনের টাকা জমা করে ভালো কিছু করার উদ্দেশে প্রথমে পাঁচজন মিলে আমাদের পথচলা শুরু হয়েছিল। এরই মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। মানবকল্যাণের বিষয়টি এমন সফলতার মুখ দেখবে, তা সত্যিই আমরা ভাবিনি।”
সরকারি বেড়া বিপিন বিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ডা. তাপস কুমার দাস। বগুড়া মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত। তিনি বলেন, “টিফিনের টাকায় একটি সংগঠন তৈরি। ভাবতেই ভালো লাগে। আমি সাধ্যানুযায়ী আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি সময় পেলেই বগুড়া থেকে বেড়ায় এসে ওদের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করি।”
শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠনের উপদেষ্টা বরুণ রায় বলেন, “ওরা অসহায়দের মধ্যে চিকিৎসা, খাদ্য, শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ করে যাচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডে প্রায়ই ওদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করি, যাতে ওরা উৎসাহ পায়। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে মানবকল্যাণে এভাবে এগিয়ে আসার বিষয়টি সত্যিই ভাল লাগার মত।”
সমাজসেবা অধিদপ্তরের পাবনা অঞ্চলের উপপরিচালক মো. রাশেদুল কবির জানান, করোনাকালিন সরকারের পাশাপাশি অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। এটা একদিকে মানবসেবা, অন্যদিকে দেশের সেবার আওতায় পড়ে। স্বেচ্ছাসেবী যারা কাজ করে সমাজসেবার পক্ষ থেকে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।”