• ঢাকা
  • রবিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ৩ ফাল্গুন ১৪৩০, ১৭ শা'বান ১৪৪৬
সিনহা হত্যার এক বছর

যে হত্যা নাড়িয়ে দিয়েছিল সারাদেশ


কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রকাশিত: জুলাই ৩১, ২০২১, ০২:০০ পিএম
যে হত্যা নাড়িয়ে দিয়েছিল সারাদেশ

সময়ের পরিক্রমায় দেশব্যাপী আলোচিত হত্যাকাণ্ড সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার এক বছর পূর্ণ হয়েছে শনিবার (৩১ জুলাই)। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এলাকায় চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা রাশেদ খান।

এ ঘটনায় আদালতে হত্যা মামলা করেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। গত ৫ আগস্ট আদালতে করা এই মামলায় তিনি টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ পুলিশের ৯ সদস্যকে আসামি করেন। পরে ৪টি মামলাই তদন্তের দায়িত্ব পায় র‌্যাব।

একপর্যায়ে র‌্যাব এ ঘটনায় প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলীসহ ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের ১১ জন পুলিশ সদস্য ও ৩ জন গ্রামবাসী।

ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জেলা পুলিশ প্রশাসনের পুলিশ সুপার, কনস্টেবলসহ পুলিশের ১,৫০৫ সদস্যকে কক্সবাজার থেকে একযোগে বদলী করা হয়।

হত্যার বিষয়ে মামলার সূত্রে জানা যায়, সিনহা মো. রাশেদ খান, শিপ্রা দেবনাথ, সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও তাহসিন রিফাত নূর কক্সবাজারের নীলিমা রিসোর্টে অবস্থান করেন। তারিখ ছিল ২০২০ সালের ৭ জুলাই। ‘জাস্ট গো’ ইউটিউবে ভিডিও চ্যানেল ডকুমেন্টারি করার সময় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে অনেক তথ্য জানতে পারেন। 

সাধারণ মানুষ পুলিশের মাধ্যমে তাদের জিম্মি দশা, অত্যাচারের ঘটনা মেজর সিনহাকে জানায়। এসব জানতে পেরে সিনহা পীড়িত হন। নীলিমা রিসোর্ট থেকে টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা হন মেজর (অব.) সিনহা ও তার সহকর্মী সাহেদুল ইসলাম সিফাত। এরপর সন্ধ্যার দিকে মারিশবুনিয়া গ্রামের টুইন্যা পাহাড়ে উঠেছিলেন মেজর সিনহা। পরে একটি মসজিদ থেকে মাইকে 'এলাকায় ডাকাত পড়েছে' বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ঘোষণার নেপথ্যে ছিলেন স্থানীয় আয়াজ উদ্দিন ও নুরুল আমিন। তারা দু'জনই পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত।

ওইদিন সকাল থেকেই সিনহার গতিবিধি নজরে রাখা হয়। একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর 'বৃক্ষরোপন অনুষ্ঠান শেষে ওসি প্রদীপকে জানানো হয়, মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ প্রাইভেটকার নিয়ে টেকনাফের শামলাপুর পাহাড়ে গেছেন। এ সময় সোর্সের মাধ্যমে বাহারছড়া ক্যাম্পের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী সিনহার প্রতি নজর রাখতে থাকেন। শামলাপুর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান (এপিবিএন) চেকপোস্টে তল্লাশির নামে গাড়ি থেকে নামিয়ে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদকে খুব কাছ থেকে ৪টি গুলি করেন ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী।

সিনহা হত্যায় ওসি প্রদীপের ভূমিকা সম্পর্কে মামলার সূত্রে জানা যায়, মেজর সিনহাকে গুলি করার কিছুক্ষণ পরেই প্রদীপ কুমার দাশ যখন ঘটনাস্থলে যান, তখনো মেজর সিনহা জীবিত ছিলেন। এ সময় ওসি প্রদীপ সিনহার ‘মুখমন্ডল ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পায়ের জুতা দিয়ে আঘাত করে' বিকৃত করার চেষ্টা করেন। এরপরই সিনহার মৃত্যু হয়। পরে লোক দেখানো তাকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।

হত্যাকাণ্ডের ৫ দিনের মাথায় ২০২০ সালের ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। যার মামলা নম্বর-এসটি-৪৯৩/২০২১ ইংরেজী, জিআর মামলা নম্বর : ৭০৩/২০২০ ইংরেজি, টেকনাফ মডেল থানা মামলা নম্বর : ৯/২০২০ ইংরেজি।

আলোচিত এই মামলায় আসামিরা হলেন টেকনাফ বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) লিয়াকত আলী, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, এসআই টুটুল, কনস্টেবল মো. মোস্তফা। তারা সবাই টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে ওইদিন রাতে কর্মরত ছিলেন।

আদালত থেকে র‌্যাব-১৫ কে এই মামলার তদন্তভার দেওয়া হয়। প্রথমে ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন র‌্যাব-১৫ এর সহকারী পুলিশ সুপার জামিল আহমদ। পরে তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তিত হয়ে র‌্যাবের সহকারী পরিচালক ও সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার খায়রুল ইসলাম তদন্তের দায়িত্ব পান। 

ওই মামলায় ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ওসি প্রদীপ কুমার দাসসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা র‌্যাব-১৫ এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খায়রুল ইসলাম।

এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৪ মাসের বেশি সময় ধরে চলা তদন্ত শেষে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর ৮৩ জন সাক্ষীসহ আলোচিত মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিল করেন র‌্যাব-১৫ এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। ১৫ জনকে আসামি করে দায়ের করা অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে প্রদীপের আত্মসমর্পণ

৬ আগস্ট প্রধান আসামি লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৭ পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। 
মামলায় প্রথমে গ্রেপ্তার হওয়া ১৪ আসামিকে র‌্যাবের তদন্তকারী কর্মকর্তা বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এদের মধ্যে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া ১২ জন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা নিজেদের দোষ স্বীকার করে আদালতের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।

গত ২৪ জুন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি কনস্টেবল সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আলোচিত এই মামলার ১৫ আসামির সবাই আইনের আওতায় আসে।

মামলার চার্জ গঠন

গত ২৭ জুন (রোববার) ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০২/২০১/১০৯/ ১১৪/১২০-খ/ ৩৪ ধারায় সব আসামির উপস্থিতিতে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালত মামলার অভিযোগ গঠন করেন। এছাড়া ৬ আসামির পক্ষে আদালতে জামিন চাওয়া হলে আদালত তা নামঞ্জুর করেন। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম মামলাটির চার্জ গঠনের শুনানি করেন।

চার্জ গঠন করে ২৬ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত একটানা ৩ দিন মামলাটির চার্জসীটভুক্ত প্রথম ১০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করে আদেশ দেন। কিন্তু কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে লকডাউনের কারণে হাইকোর্টের নির্দেশে সারাদেশের মতো কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ  আদালতে স্বাভাবিক কার্যক্রম না চলায় নির্ধারিত ধার্য দিনে সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন মামলাটির রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী ও কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) এডভোকেট ফরিদুল আলম।

তিনি জানান, এ মামলায় ৮৩ জন চার্জশিটভুক্ত সাক্ষী রয়েছে। আদালতে স্বাভাবিক কার্যক্রম চললে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণসহ অন্যান্য আইনি কার্যক্রমও স্বাভাবিক নিয়মে চলবে। বিচারকাজ শুরুর অন্যান্য কাজ এগিয়ে রয়েছে। আদালত খুললে এই মামলার কাজও শুরু হবে।

এদিকে সিনহা হত্যা মামলাটি বেআইনি ও অবৈধ দাবি করে ৪ অক্টোবর মামলার প্রধান আসামি লিয়াকতের আইনজীবী মাসুদ সালাহ উদ্দিন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একটি মামলা করেন। কিন্তু ওই মামলার বিশেষ কোনো অগ্রগতি এখনও পর্যন্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

সিনহা হত্যার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ গত ২ আগস্ট চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই কমিটি সরেজমিনে তদন্ত করে ঘটনার কারণ ও উৎস অনুসন্ধানের প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশসহ জমা দেন।

বর্তমানে কারাগারে যারা আছেন

মামলায় কারাগারে থাকা ১৫ আসামিরা হলেন বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, রুবেল শর্মা, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাগর দেব, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ, পুলিশের করা মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।

Link copied!