শেরপুরে বসবাসরত ভাসমান বেদেপল্লীর পরিবারগুলো ভালো নেই। লকডাউনের কারণে গ্রামগঞ্জে ঠিকমতো ঘুরতে না পারায় পরিবারগুলোর রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। স্থায়ী বাসিন্দা না হওয়ায় আর্থিক সহযোগিতা পাচ্ছেন না তারা। পাচ্ছেন না করোনাকালীন প্রণোদনাও। এজন্য তারা পড়েছে বিপাকের মধ্যে।
শেরপুরের ব্রহ্মপুত্র সেতু সংলগ্ন আব্দুস সামাদ গরুর হাটের পাশে ইউক্যালিপটাস বাগানে বসবাস করছে বেদেপল্লীর ৩০টি পরিবার। এছাড়াও জেলার অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরো প্রায় ৭০টি পরিবার। সবমিলিয়ে শতাধিক বেদে পরিবার খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছে।
নারী বেদেরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে সাপ দেখানো, দাঁত ব্যথা সারানো, দাঁতের পোকা বের করা, তাবিজ-মাদুলি, শিকড়-বাকড় বিক্রি করা, শিঙ্গা লাগানোসহ বিভিন্নভাবে রোজগার করতেন। আর পুরুষরা গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে সাপ, বেজি ও বানরের খেলা দেখিয়ে, যাদু খেলা দেখিয়ে এবং শারীরিক নানা কসরত দেখিয়ে কিংবা ওষুধ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
কিন্তু শেরপুর জেলায় করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় প্রশাসন হাট-বাজারে লোক সমাগম নিষিদ্ধ করেছে। চলছে লকডাউনও। তাই এখন সাপের খেলা, বানরের খেলা বা তাবিজ বিক্রির মজমা বসাতে পারছেন না তারা। বাড়ি বাড়ি যেতেও পারছেন না। এতে তাদের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছেন তারা। পাখি শিকার করে তার মাংস খাওয়াসহ নানাভাবে দিন চলছে তাদের।
বেদে কন্যা কেয়া রাণী বলেন, “শেরপুরে চলমান লকডাউন ছাড়াও অনেক দিন ধরেই হাট-বাজারে লোক সমাগম নিষিদ্ধ রয়েছে। তাই এখন সাপ ও বানরের খেলা এবং তাবিজ বিক্রি করা যাচ্ছে না। হাট বাজার ছাড়াও গ্রামগঞ্জে মজমা বসাতে গেলেও পুলাপান ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। আমরা নিজেদের পেটের জন্য তিন বেলার খাবার যোগাড় করতে পারছি না এখন।“
নার্গিস নামের আরো একজন বলেন, “আমাগো তো কোনো জাগাজমি নাই। যেহানে পারি সেহানেই থাহি। কামাই না অইলে খামু কী গো। মানুষ তো আমাগোরে বাড়ি যাইবার দিবার চায় না। বাজারেও মজমা বসান যায় না। এহন আমরা কী করমু?”
বেদেনী শিউলী বানুর কাছে দুটি সাপ ছিল। একটি ‘কালনাগিনী’ আর একটি ‘দুধরাজ’। খাবারের অভাবে ‘দুধরাজ’ মারা গেছে গত সপ্তাহে বলে জানান শিউলী। শিউলী বলেন, “হামারও কামাই বন্ধ স্বামীরও কামাই বন্ধ। হামাদের তো আর ব্যাংক ভরা ট্যাহা নাই। তাইলে হামরা ক্যামনে খাইমু, ক্যামনে চলমু।”
বেদেপল্লীর বাবু সরকার বলেন, ‘আমি হাটে-বাজারে বানর আর বেজির খেলা দেখিয়ে যা আয় রোজগার করি, তা দিয়েই সংসার চালাই। এহন তো কোনো মজমা বসাবার পারি না। এহন খুব কষ্টের মধ্যে দিন পার করছি। কেউ তো আমাগো সাহায্যও দেয় না। এহন আমরা কী কইরা চলি।”
স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী আলমগীর আল আমিন হারুন বলেন, “আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের অংশ হচ্ছে বেদে পরিবারগুলো। নানা কারণে হারিয়ে যাচ্ছে এসব বেদে পরিবারে ঐতিহ্য। বেদেদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিভিন্ন ধরনের ম্যাজিকসহ বানর নাচ ও সাপ খেলা দেখতে সবাই পছন্দ করে। তাই করোনার এ দুর্দিনে তাদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবার মানবিক দায়িত্ব।”
শেরপুর সদর উপজেলার চরপক্ষীমারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আকবর আলী বলেন, “আমরা এসব বেদে পরিবারগুলোকে নিরাপত্তা দিয়ে আসছি। কিন্তু তাদের জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ না থাকায় আর্থিক সহায়তা করতে পারছি না। তবে ইউএনও ও জেলা প্রশাসক স্যার আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, তাদের জন্য সাহায্যের একটা ব্যবস্থা করবেন।”
শেরপুর সদর উপজেলার ইউএনও ফিরোজ আল মামুন জানান, “সেখানে অবস্থানরত বেদে পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছে। তাদের জন্য আলাদা বরাদ্দেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে।”