‘ন্যাটোর সম্প্রসারণবাদ’— এমন একটা শব্দ ইদানীং বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। সেই সঙ্গে খুব চালু যে ন্যারেটিভ সেটা হলো, ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে চাওয়ায় কিংবা বলা চলে ন্যাটোই ইউক্রেনকে কোলে তুলে নেওয়ার সব প্রক্রিয়া প্রায় সমাধা করে ফেলার কারণেই আজকের এই যুদ্ধ।
তা এই বিষয়ে কয়েকটা কথা বলার ছিল।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক শুরুতেই। আজ থেকেও প্রায় বছর বিশেক আগে এস্তোনিয়ার রাজধানী তালিন শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে একটি রুশ বীরের ভাস্কর্য সরিয়ে শহরের বাইরের দিকের একটি পার্কে স্থাপন করা হয়। এতে করে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয় এস্তোনিয়ায় রুশ আর সীমান্তের ওপারে থাকা রুশরা। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে এস্তোনিয়ায় সব ইন্টারনেট সিস্টেম হ্যাক করে প্রায় গোটা দেশটাকেই ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। এরপর অবশ্য এস্তোনিয়া এ ধরনের হ্যাকিং ঠেকাবার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়, যাতে করে এমন ঘটনা ভবিষ্যতে না ঘটে।
শুধু একটি ভাস্কর্য সরাবার কারণেই এত বড় প্রতিশোধ, আর সেখানে আজ যদি ন্যাটোর সৈন্য বসে না থাকত, তাহলে ঘটনা যে কোন দিকে মোড় নিতে পারত, সেটা সহজেই অনুমেয়। এস্তোনিয়ার মতো বাল্টিক দেশগুলো ন্যাটোতে যোগ দিয়েছিল অনেকটা নিজের গরজেই। ন্যাটোর উসকানি কিংবা চাপাচাপিতে নয়। রাশিয়ার দুর্বল সামরিক ও অর্থনৈতিক সময়ে। এখনকার সময়ে তারা যোগ দিতে চাইলে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ঘটনা বহু দূর গড়াত। অনেকে বলতেই পারেন, সুইডেন কিংবা ফিনল্যান্ডের মতো দেশ তো ন্যাটোতে যোগ না দিয়েই রাশিয়ার সঙ্গে একটা তুলনামূলক সদ্ভাব বজায় রেখে বছরের পর বছর চলছে। তারা যদি চলতে পারে, তাহলে এই বাল্টিক দেশগুলো কিংবা ইউক্রেন কেন একই পথ নিতে পারবে না? এখানে কিন্তু একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। সুইডেন কিংবা ফিনল্যান্ড সরাসরি রাশিয়ার কলোনি ছিল না। যেমনটি এই দেশগুলো ছিল মাত্র ত্রিশ বছর আগেও। ফলে এদের হারাবার যন্ত্রণা কিংবা আক্রোশ রাশিয়ার জন্য সংগত কারণেই বেশি। পুরোনো ক্ষতের মতো।
এবারে আসি ইউক্রেনের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ব্যাপারে। অনেকের ভাষ্য শুনে মনে হচ্ছে যেন আগামী মাসেই ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিয়ে ফেলত। তারপর সেখানে বসত আমেরিকার মিসাইল। সে কারণে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই ফেব্রুয়ারি মাসে এই আক্রমণ। ভুল। ইউক্রেন কিন্তু ন্যাটোতে যোগ দিতে চাইছে বহু আগে থেকে। বলতে গেলে বছর পনেরো-বিশ আগে থেকেই। কিন্তু ন্যাটোর অন্যান্য দেশের নানা ওজর-আপত্তিতেই কিন্তু এতকাল ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে পারেনি।
বাকিদের আপত্তি কেন? বহুবিধ। ইউক্রেনের প্রায় চল্লিশ ভাগ মানুষ এতকাল কিন্তু ন্যাটোতে কিংবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগদানের পক্ষে ছিল না। অন্যদিকে ইউক্রেনের ভেতরেই একটা সাইজেবল পপুলেশন আছে, যারা রুশ। অন্যদিকে এমন অনেকে আছে, যাদের পরিবারে রুশ কানেকশন আছে। হয়তো মায়ের দিকের দিদিমা রুশ, বাবার দিকের লোকেরা ইউক্রেনিয়ান। ফলে এমন একটি দেশে ন্যাটোর ঘাঁটি গড়লে বহু গোপনীয় তথ্য ‘ওপারে’ পাচার হওয়ার ভয় আছে।
শুধু সেটাই না, একটি দেশ যখন ন্যাটোর পতাকা তলে আসে, তখন তার প্রতিটি ইঞ্চির নিরাপত্তার দায়ভার এসে পড়ে ন্যাটোর ঘাড়ে। ইউক্রেন একটি বিশাল দেশ। অর্থনৈতিকভাবেও ইউক্রেন তেমন শক্তিশালী দেশ নয়। ফলে এমন একটি দেশ ন্যাটোতে এলে তার নিরাপত্তার একটা বিরাট ব্যয়ভার কার্যত এসে বর্তাবে বাকি দেশগুলোর ঘাড়ে। সেটিও অন্য দেশগুলোর খানিকটা আপত্তির কারণ। গত দশ-বিশ বছরে যে দেশগুলো ন্যাটোতে যুক্ত হয়েছে, যেমন ধরুন মন্টেনিগ্র কিংবা নর্থ মেসিডোনিয়া, এরা খুবই ক্ষুদ্র দেশ। ফলে এরা গরিব হলেও ন্যাটোর ওপর অর্থনৈতিক দায়ভার ততটা নয়। এখানে একটা উদাহরণ দিই। কয়েক বছর আগে নেদারল্যান্ডসে একটি গণভোট আয়োজন হয়। মজার ব্যাপার হল, গণভোটটি কিন্তু ছিল ইউক্রেনকে নিয়ে। ভোটটি ছিল এমন, ইউক্রেন যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দেয়, তবে কি ডাচরা সেটি সমর্থন করবে? গণভোটের ফল ছিল ‘না’। কেন না? কারণ, ডাচদের বক্তব্য ছিল ইউক্রেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিলে হুড়মুড় করে ইউক্রেনিয়ানরা ছুটে আসবে পশ্চিমে। অন্যদিকে তাদের দেশের বহু অবকাঠামো খাতে ইউনিয়নের পয়সা খরচ হবে, যার ব্যয়ভার শেষমেশ গিয়ে বর্তাবে ডাচ দেশের ট্যাক্স পেয়ারদের ওপর। আবার ইউক্রেন একটি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত দেশ। এমন একটি দেশকে ইউনিয়নে টেনে আনা মানে ঝামেলা আরও বাড়ানো। এই গণভোটের ফলাফল কিংবা জনগণের মতামত দেখেই বোঝা যায়, ইউক্রেন চাইলেই যে তাকে ইউনিয়নে বা ন্যাটোতে ঢুকিয়ে ফেলা হবে, ব্যাপারটা এত সরল নয়।
সে জন্যই বলছি যে, ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগদানের জন্য তৈরি কিংবা উদগ্রীব হলেও খোদ ন্যাটোর বাকি দেশগুলোই এখনই তাকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে একমত হতো না। এমন একটি সম্ভাবনা থাকলেও সেটি আশু নয়, হয়তো আরও বহু বছর বাদে ঘটার মতো একটি ব্যাপার ছিল।
ন্যাটোর সম্প্রসারণ এই যুদ্ধের মূল কারণ, এটি আমি মানতে খানিকটা নারাজ। বরং এর পেছনে ভিন্ন কিছু কারণ আছে।