স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী, প্রাণ উৎসর্গ করা এক আন্দোলনের নাম কমলা বিপ্লব, যা ইউরো-ময়দান নামেও পরিচিত। এই গণ-অভ্যুত্থানের এক শ্বাসরুদ্ধকর উপস্থাপনা দেখলাম “উইন্টার অন ফায়ার: ইউক্রেনস ফাইট ফর ফ্রিডম” প্রামাণ্যচিত্রে।
ইউক্রেনের রুশ-সমর্থিত সরকারের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকভিচ যখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে একসাথে কাজ করার চুক্তি করতে গিয়েও সেখান থেকে সরে আসেন এবং পুতিনের বলয়ের ভেতর ঢুকে পড়েন, তখন ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর থেকে শুরু হয় আন্দোলন। প্রথমে দুই-আড়াই শ লোক জড়ো হতে থাকেন কিয়েভের পরিচিত স্কয়ার ‘ময়দানে’, বাংলায় ময়দান মানে মাঠ। তো এই ময়দানে হাজার হাজার লোক জড়ো হতে থাকেন, কারণ তারা মনে করেন ভিক্টর তাদের প্রতারিত করেছেন। তাদের এই অবস্থান কর্মসূচি এক অসম্ভব রকম লড়াইয়ে পরিণত হয়। ভিক্টরের গুন্ডা বাহিনী ‘বেরকুটে’র গ্রেনেড, গুলির বিপরীতে তারা খালি হাতেই ‘যুদ্ধ’ চালিয়ে যায়। শেষে জনগণের চাপ সহ্য করতে না পেরে, তড়িঘড়ি পদত্যাগ করে, ফেব্রুয়ারির এক শেষ রাতে চোরের মতো লুকিয়ে ভিক্টর রাশিয়ায় পালিয়ে যান। টানা ৯৩ দিনের আন্দোলন শেষ হয় ১২৫ জন আন্দোলনকারীর আত্মাহুতির মাধ্যমে। ৬৫ জন এখনো নিখোঁজ। আহত হন ১ হাজার ৮৯০ জন। রুশ-সমর্থিত প্রেসিডেন্ট ভিক্টরের এই পরাজয় রাশিয়া মেনে নিতে পারেনি। ইউক্রেনের ভেতর তাই রাশিয়া রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উস্কে দেয় এবং ২০১৫ সালে রাশিয়া খোদ ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে ক্রিমিয়াকে করে দেয় বিচ্ছিন্ন। আর বর্তমানে আবারও রুশ আগ্রাসনের কথা সবারই জানা। দোষের ভেতর এই ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ন্যাটোভুক্ত হতে চাইছিলেন।
এভজেনি অ্যাফিনিভস্কি পরিচালিত ‘উইনটার অন ফায়ার’ ছবিটি দেখে আমার ‘শাহবাগ আন্দোলনে’র কথাই মনে হয়েছে। সেটাও হয়েছিল ২০১৩ সালে। এভজেনির ছবিটির পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের অর্থায়ন আছে। সম্প্রতি রুশ আগ্রাসনের সময় ইউক্রেনে অবস্থান করছেন অস্কারজয়ী মার্কিন অভিনেতা ও পরিচালক শ্যন পেন। উদ্দেশ্য প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ।
পূর্ব ও পশ্চিমের দ্বার ইউক্রেনকে ঘিরে টানাপোড়েন শুরু নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকেই, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙল। সেখানে ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ছাড়াও রয়েছে প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদের ওপর আধিপত্য ও বিশাল পুঁজির লাভ-লোকসান। সেসব সরিয়ে এই ছবিটিতে জনগণের শক্তির যে উদ্বোধন ও আপসহীন চিত্ত দেখানো হয়েছে, সেটাই চোখ ছুঁয়ে গেছে, সজল চোখেই দেখতে হয়েছে পুরো ছবি।