• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ভরাট হচ্ছে পুকুর, কে আসলে মালিক?


জাহিদ রাকিব
প্রকাশিত: মে ২৭, ২০২৩, ১০:০২ পিএম
ভরাট হচ্ছে পুকুর, কে আসলে মালিক?

রাজধানীর গেন্ডারিয়ায় আইন অমান্য করে শতবর্ষের ডিআইটি পুকুর ভরাট করার অভিযোগ উঠেছে জায়গার মালিকের বিরুদ্ধে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জলাশয় ভরাট করা নিষিদ্ধ। এলাকাবাসীর অভিযোগ রাতের বেলা ট্রাকভর্তি বালু ফেলে এই পুকুর ভরাট করা হয়েছে। দিনের বেলা মার্কেট নির্মাণের কাজ বন্ধ থাকলেও রাতের বেলা দোকান তুলে পুকুর দখল করা হচ্ছে। তবে জায়গার মালিক জাকির হোসেনের দাবি, “অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। পুকুর দখলের জন্য কোনো বালু ফেলা হচ্ছে না।”

সরেজমিনে গেন্ডারিয়া শতবর্ষী ডিআইটি পুকুর এলাকা দেখা যায়, পুকুরের চারপাশে ঘেঁষে ছোট ছোট মার্কেট, দোকান ও বেশ কয়েকটি রিকশার গ্যারেজ। ময়লা-আবর্জনা ফেলে প্রায় ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। পুকুরটি চারপাশ থেকে একটু একটু করে ভরাট হচ্ছে।  

এলাকাবাসীরা জানায়, পুকুরে একাংশ অস্থায়ী কার্যালয় বানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাহানা আক্তার।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানায়, নব্বইয়ের দশকে এই পুকুরে গোসল করত স্থানীয় লোকজন। রান্নাবান্নাসহ দৈনন্দিন নানা কাজের জন্য পুকুরের পানি ব্যবহার করত বাসিন্দারা। পরবর্তী সময়ে এখানে কয়েক বছর মাছের চাষও হয়েছে। এ ছাড়া ওই এলাকায় কোনো বাড়িতে আগুন লাগলে তা নেভানোর জন্য এই পুকুরের পানি ছিল অন্যতম উৎস।

এদিকে পুকুরটি রক্ষায় এলাকাবাসী সিটি করপোরেশন ও রাউজকে বিভিন্ন সময় চিঠি দিয়েছে। সেই চিঠিতে এলাকাবাসী দাবি করেন, পুকুরটি সংরক্ষণ করে সুপেয় পানি ও অগ্নিকাণ্ডে পানি সরবারহ ও অবৈধ অংশ উদ্ধার করে চারদিকে বাউন্ডারি দেওয়া হোক, যাতে কেউ পুকুরটি ভরাট করতে না পারে। কিন্তু সেই চিঠি দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দেখা যায়নি।

রাজউকের সম্পত্তি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পুকুরটির মালিক ছিল রাজউক। রাজউকের সদস্য (ভূমি) নুরুল ইসলাম সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “বর্তমানে যারা পুকুরটি দখল করছে তারা একের পর এক মামলা করায় আমরা সেগুলো মোকাবেলা করতে পারছি না। সবশেষ আমরা রিভিউ পিটিশনে হেরে গিয়েছি। ফলে পুকুরটির মালিকানা চলে যায় তাদের হাতে। আমরা চাই, পুকুরটি রক্ষায় রাজউকের বাইরেও সবাই এগিয়ে আসুক।” জনস্বার্থে পুকুরটি সংরক্ষণে এগিয়ে আসা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

দখল প্রসঙ্গে ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাহানা আক্তার সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “এই জায়গাটি আমি জাকির হোসেন থেকে ভাড়া নিয়েছি। এই সম্পত্তি তাদের পারিবারিক সম্পত্তি। এই বাইরে আমি কিছু বলতে পারবো না।”

জায়গার মালিক দাবি করা জাকির হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “পুকুরটি ১৯৬৩ সালে রাজউক অধিগ্রহণ করে। সেই সময় আমাদের যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল সেটা আমরা গ্রহণ করিনি। পরবর্তী সময়ে আমরা আদালতে রিট করলে রায় আমাদের পক্ষে আসে। রায় আসায় রাজউক পরে আপিল করে। সেখানেও রায় আমাদের পক্ষে আসে। এরপর গণপূর্ত থেকে রাউজকে চিঠি দেওয়া হয়। এতে করে পুকুরটি আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এখনও রাউজক আমাদের পুকুরটি বুঝিয়ে দেয়নি।”

রাতের বেলায় বালু ফেলে দখলের বিষয় অস্বীকার করে তিনি বলেন, “এখানে রাতে বালু ফেলে পুকুর ভরাটের বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা। আগ থেকে এখানে যে দোকান ছিল সেই দোকানগুলোই আছে। নতুন করে পুকুরের কোনো পাড় ভরাট করা হচ্ছে না।”  

পুকুর দখল ও রক্ষাণাবেক্ষণের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “রাজধানীতে পুকুর ও জলাশয় দেখভাল করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তর ও রাউজকের। এই জলাশয়গুলো যদি আমাদের হস্তান্তর করে তাহলে আমরা দেখভাল করবো। এর আগে কোনো পুকুর দখল হয়ে গেলে আমাদের কিছু করার নেই।”

জলাশয় ও পুকুর ভরাট হয়ে গেলে পরিবেশের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে? এ নিয়ে কথা বলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমাদ কামরুজ্জামান মজুমদার। তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “২০১৭ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরের যেসব এলাকায় জলাশয় পুকুর ও বৃক্ষের আধিক্য নেই যেসব এলাকায় তাপমাত্রা অন্য এলাকার চেয়ে ২ থেকে ৩ ডিগ্রি বেশি। জলাশয় ও পুকুর প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিক রাখে, তেমনই যেকোনো অগ্নিকাণ্ডে পানির অন্যতম উৎস হিসেবেও কাজ করে।”

জলাশয় ও পুকুর রক্ষায় তিনি বলেন, “রাজধানীতে দখল হয়ে যাওয়া খাল ও পুকুর উদ্ধার করে খনন করতে হবে। আর যেসব পুকুর আর জলাশয় আছে, সেগুলো সংস্কার করে ব্যবহার উপযোগী করতে হবে।”  

ঢাকার দুই সিটিতে ড্যাপ ২০৫টি পুকুরের কথা বললেও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) জরিপে সে সংখ্যাটা আরো বেশি উঠে এসেছে। ২০২০ সালে রাজধানীর পুকুর নিয়ে আরডিআরসি জরিপটি পরিচালনা করেছিল। ঢাকায় ওই সময় ছোট-বড় মিলিয়ে ২৪১টি পুকুর ছিল। এর মধ্যে বেশির ভাগই ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন। এর বেশিভাগ ভরাট করে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন বানানো হয়েছে।

Link copied!