• ঢাকা
  • রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

একুশে আগস্টের ভয়াবহ স্মৃতি ভুলতে পারেননি আহতরা


সফিকুল ইসলাম
প্রকাশিত: আগস্ট ২১, ২০২৩, ০৮:৩৮ এএম
একুশে আগস্টের ভয়াবহ স্মৃতি ভুলতে পারেননি আহতরা

আগস্ট মানেই বাঙালির শোকের মাস, বেদনার মাস। এই মাসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করে ষড়যন্ত্রকারীদের দল। সে সময় ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা শেখ হাসিনাকেও স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। এ জন্য তারা এই আগস্টকেই বেছে নিয়েছিল। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। সেদিনের সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তিনি। অস্থায়ী মঞ্চে বক্তব্য শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে একের পর এক গ্রেনেড ছোড়া হয়।

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহতরা এখনো সেদিনের ভয়াবহ স্মৃতি ভুলতে পারেননি। এখনো তাদের কানে বাজে গ্রেনেডের সেই বিকট শব্দ, আহত মানুষের আর্তচিৎকার। অনেকে শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন গ্রেনেডের স্প্লিন্টার। একদিন ঘাতকের বিচার হবে—এমন প্রতীক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন তারা। সেদিন ১৩টি গ্রেনেডের বিস্ফোরণে মুহূর্তেই সমাবেশস্থল পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। এই হামলায় আওয়ামী লীগের ২২ জন নেতাকর্মী নিহত হন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ শত শত নেতাকর্মী আহত হন। সে সময় মঞ্চ থাকা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মীরা মানববর্ম তৈরি করে দলীয় সভাপতিকে জীবিত উদ্ধার সুধাসদনে নিয়ে যেতে পারলেও মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। গ্রেনেডের বিস্ফোরণের বিকট শব্দে শেখ হাসিনার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখনো শত শত মানুষ ওই হামলার ক্ষত নিয়ে মৃতের মতো দিন কাটাচ্ছে।

২০০৪ সালে ২১ আগস্টের ভয়াবহ হামলায় গুরুতর আহত হন সে সময়ের কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক রাশিদা আক্তার রুমা। বর্তমানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী মহিলা লীগের সহসভাপতি তিনি। সেদিনের কথা বলতে গিয়ে এখনো আঁতকে ওঠেন তিনি। কথা হয় রাশিদা আক্তার রুমার সঙ্গে। তিনি বলেন, “প্রথম বিস্ফোরণটা আমাদের ওপরেই পড়ল। তখন আমি ও আইভি আন্টি পড়ে যাই। আমার জ্ঞান ছিল না। যখন পড়ে গেলাম তখন স্প্লিন্টারগুলা গায়ে এসে পড়ছে। বাড়ি খেয়ে আমার ১৮টা দাঁত পড়ে গেল। পরে ২২টা সেলাই হলো, বুকে সেলাই, হাতে সেলাই হলো। আমার ১৭ বার অপারেশন করা হলো।”

গ্রেনেড হামলায় আহতদের একজন ঢাকার কেরানীগঞ্জের সন্তান ও তৎকালীন ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র সহসভাপতি আলতাফ হোসেন বিপ্লব। ঘটনার দিন অস্থায়ী মঞ্চ ট্রাকের পেছনে দাঁড়িয়ে ভাষণ শুনছিলেন। হামলার প্রথম গ্রেনেডের আঘাতে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে আবার গ্রেনেডের শব্দে তিনি জ্ঞান  ফিরে পেয়ে দেখেন, আহত-নিহতদের রক্তে ভেজা শরীর। সমাবেশে অংশ নেওয়া লোকজন আহত-নিহতদের ওপর দিয়ে দৌড়াচ্ছেন। যে যার মতো নিরাপদ গন্তব্যে যেতে ছোটাছুটি করছেন। তিনি বলেন, “এলাকাটিতে কোনো যানবাহন না থাকায় মানুষ কাঁধে এবং কোলে করে আহত-নিহতদের হাসপাতালে ও নিরাপদ আশ্রয়ে নিচ্ছিলেন। আমি বহু কষ্টে পাশের একটি দোকানে গিয়ে উঠলেও পুলিশ আতঙ্কে আমাকে দোতলার একটি দর্জির দোকানে নিয়ে যায়। সেখানে এক দর্জি আমার পরনের প্যান্টটি কেটে দেন এবং রক্তে ভেজা জুতা খুলে দেন। এ সময় আমি সবকিছু দেখলেও কথা বলতে পারছিলাম না। আমি সেখানে থাকতে থাকতে ঘটনাস্থলে আরও ১০-১৫টি গ্রেনেড হামলা হয়। পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা গাড়ি নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। এক লোক এসে আমাকে জানান নিচে গাড়ি আসছে আমাদের জন্য। তারপর তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল সাহেবের গাড়িতে করে আমাকেসহ নয়জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার আগেই কানে আওয়াজ আসতে শুরু করে আহতদের হাসপাতাল থেকেই আটক করা হবে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে আমাকে গোপনে নিয়ে ভর্তি করা হয় পুরান ঢাকার আরাফাত হাসপাতালে। সেখানেও গ্রেপ্তার আতঙ্কে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় আমার এক সহকর্মীর বাসায়। সেখান থেকে সিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়ে ১০ দিন পর ভারতে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। সেখানে দুই পায়ে অপারেশন করে অসংখ্য স্প্লিন্টার বের করা হয়। তবে আরও কিছু স্প্লিন্টার বের করা সম্ভব নয় বলে জানান চিকিৎসকরা। এখনো অসংখ্য স্প্লিন্টার দুই পায়ে রয়েছে।”

বিপ্লব বর্তমানে কেরানীগঞ্জ মডেল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, এখন ওষুধ খেয়ে মোটামুটি ভালো থাকলেও মাঝে মধ্যেই প্রচণ্ড ব্যথায় দুই পা প্রায় অবশ হয়ে যায়। ২১ আগস্টের নারকীয় তাণ্ডবের রায় দেখেছেন, তবে বিদেশে পলাতক খুনিদের দেশে এনে রায় কার্যকর হওয়া দেখে যেতে চান তিনি।

ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান বলেন, শরীরের কয়েকটি স্থানে রগের মধ্যে একটা দুইটা করে স্প্লিন্টার আছে। এগুলো অপারেশনও করা যাবে না। সেদিন মনে হচ্ছে কেয়ামত চলে আসছে।

সেই দিন ভয়াবহ হামলায় আহত হয়েও নিজের চিকিৎসার পরোয়া না করে অন্যের জীবন রক্ষায় এগিয়ে যান বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিচালক প্রফেসর ডাক্তার এম এ রউফ সরদার। তিনি বলেন, “যখন আমি ইমারজেন্সিতে ঢুকলাম তখন সবাই একসঙ্গে বলছিল আমাকে দেখেন স্যার। তখন আমি হাসপাতালের সমস্ত ডাক্তারকে বলি চলে আসেন।”

সেই নারকীয় এ ঘটনা থেকে রেহাই পায়নি গণমাধ্যম কর্মীরাও। স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা নিয়ে এখনো তারা জীবন যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। তাদেরই একজন এটিএন বাংলা বিশেষ প্রতিনিধি সাঈদ রিয়াজ। তিনি বলেন, “আমি ক্যাবল গোছাতে গোছাতে ভাবছিলাম টপ লাইনটা কী হতে পারে। ঠিক সেই মুহূর্তে কয়েকটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। তারপর আমি ডান পাশে পড়ে যাই। পড়ে যাওয়ার পর আমি পায়ের কোনো কিছু বুঝতে পারছিলাম না। পরে হঠাৎ বুঝলাম স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা করছে।”

এমন শত শত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী স্প্লিন্টারের আমৃত্যু যন্ত্রণা শরীরে বয়ে চলেছেন দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। তাদের সবার দাবি একটাই। গ্রেনেড হামলায় জড়িত এবং এর মদদদাতাদের প্রত্যেকের বিচার।

Link copied!