সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সাপ্তাহে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই হিসেবে জাতীয় নির্বাচনের বাকি তিন মাসেরও কম সময়।
আওয়ামী লীগের ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত বিভক্ত ‘ঢাকা’ ওয়ার্ড-থানা পর্যায়ে সম্মেলন হলেও এখনো কমিটি ঘোষণা করতে পারেনি দলটি। এরপরও পুরোদমে ভোটের প্রস্ততি শুরু করেছে ক্ষমতাসীন দলটি। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে নৌকা মার্কায় প্রার্থী বাছাইও শুরু করেছেন দলীয়প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে জেলা-উপজেলায় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গঠন করা হয়েছে কমিটি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের অধীনে ২৪টি থানা, ৭৫টি ওয়ার্ড এবং ওয়ার্ডগুলোর অধীনে রয়েছে কয়েকটি করে ইউনিট। এরমধ্যে ইউনিটগুলোতে প্রথমবারের মতো সম্মেলন করে কমিটি দেওয়া হয়েছে। তবে সম্মেলন হলেও কোনো ওয়ার্ড ও থানায় নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়নি।
অন্যদিকে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের অধীনে থাকা প্রায় ৮০০টি ইউনিট রয়েছে। ইউনিট কমিটি হলেও ৬৪ ওয়ার্ড ও ২৬ থানায় সম্মেলন করেও কমিটি ঘোষণা করা হয়নি।
দলের সাংগঠনিক গতি বাড়াতে ইউনিট থেকে সম্মেলন শুরু করে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ। লক্ষ্য ছিল দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজধানীর সকল ওয়ার্ড ও থানা কমিটি গঠনের মধ্যদিয়ে দলকে গুছিয়ে আনা।
সে লক্ষ্যেই ঢাকার ইউনিট-ওয়ার্ড এবং থানার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সম্মেলনের ১ বছর পার হলেও কমিটি ঘোষণা করতে পারেননি মহানগরের নেতারা। সম্মেলনের পর দীর্ঘদিনেও থানা-ওয়ার্ড কমিটি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ ও হতাশ তৃণমূলের পদপ্রত্যাশীরা। এরইমধ্যে উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগের পদপ্রত্যাশী বেশ কয়েকজন নেতা প্রয়াত হয়েছেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের অন্তর্গত ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান মোল্লা সজল বলেন, “ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ে কমিটি না থাকার কারণে সমস্যা হচ্ছে। কারণ আমরা যারা সাবেক আছি, বা যারা নতুন করে পদপ্রত্যাশী হয়েছি, সবার মাঝে সমন্বয়হীনতা হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই মূহূর্তে সমন্বয় থাকা খুবই প্রয়োজন। যোগ্যদের দিয়ে (ওয়ার্ড-থানা) কমিটি দিতে পারলে নির্বাচনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে কমিটিতে যদি কোনো বিতর্কিতকে সভাপতি-সম্পাদক দেওয়া হয়-তাহলে নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
একই কথা বলেছেন ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি চৌধুরী আশিকুর রহমান লাভলুসহ নগরের আরও বেশ কয়েকজন নেতা।
কী আছে গঠনতন্ত্রে
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, সম্মেলনে আগের কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে নতুন কমিটি ঘোষণা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে কোনো কারণে সেটি সম্ভব না হলে কেন্দ্রের কাছে কারণ ব্যাখ্যা করে সময় বাড়ানোর আবেদন করতে হয়, সেটাও করেননি ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। এতে বিলুপ্ত কমিটিগুলো নেতৃত্বশূন্য রয়েছে অনেকদিন ধরে। কবে নাগাদ নতুন কমিটি ঘোষণা করা হতে পারে, সে বিষয়ে কিছু বলতে পারছেন না নগর নেতারা।
উত্তর-দক্ষিণের নেতাদের দাবি, বিএনপির আন্দোলনের বিপরীতে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রতি সপ্তাহেই শান্তি সমাবেশ করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। সমাবেশে মিছিল নিয়ে হাজির হচ্ছেন। তারা বলছেন,যথারীতি ইউনিট, ওয়ার্ড ও থানা শাখার সম্মেলন করেছি। ইউনিটগুলোর কমিটি হয়ে গেছে। ওয়ার্ড ও থানাগুলোর কমিটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, শিগগিরই ঘোষণা করা হবে।
সম্প্রতি বিভক্ত ঢাকা মহানগরের নেতাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি যৌথসভায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দ্রুত কমিটি দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, রাজধানীতে অনুষ্ঠিত সমাবেশেও কমিটি নিয়ে কথা বলেছেন ওবায়দুল কাদের। একইসঙ্গে ঢাকা মহানগরের ওয়ার্ড-থানা কমিটি না দেওয়ায় নগরের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছেন তিনি। একইসঙ্গে নগর নেতারা সময় চাইলে তাতে সম্মতি দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে নতুন কমিটির খসড়া প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। তবে পেরিয়ে গেছে সেপ্টেম্বর, পেরিয়ে গেছে অক্টোবর। চলতি মাসের প্রথম সাপ্তাহেও কমিটি ঘোষণা করতে পারেনি ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ।
এদিকে ঢাকা উত্তর-দক্ষিণের ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ে যোগ্যদের পদে আনতে সর্বশেষ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক ও লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে নতুন কমিটি গঠনের আগ পর্যন্ত পূর্বের কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তরাই চলতি দায়িত্ব পালন করার কথা জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
গত ২১ সেপ্টেম্বর বিকেলে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সভাকক্ষে প্রতিনিধি সভায় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, “থানা-ওয়ার্ডের কমিটি হোক বা না হোক, যারা আগে যে দায়িত্বে ছিলেন, তারা আপাতত সেই দায়িত্ব পালন করবেন।”
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফী বলেন, “ইউনিটগুলোর কমিটি হয়ে গেছে। ওয়ার্ড ও থানাগুলোর কমিটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, শিগগিরই ঘোষণা করা হবে। এছাড়া নতুন কমিটি ঘোষণা না করা পর্যন্ত যারা আগে থানা-ওয়ার্ডের দায়িত্বে ছিলেন,তারা চলতি দায়িত্ব পালন করবেন-এমন নির্দেশনাও আমরা দিয়েছি।”
কমিটি কবে নাগাদ ঘোষণা হতে পারে-জানতে চাইলে তিনি বলেন, “দলের পক্ষ থেকে যেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হবে সেভাবেই করা হবে।” একইসুরে কথা বলেছেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান। তিনি বলেন, “সব ইউনিট, ওয়ার্ড ও থানা শাখার সম্মেলন হয়েছে। নতুন কমিটিগুলো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অনেকগুলো কমিটির নাম যাচাই-বাছাই করে আমরা একটা পর্যায়ে এসেছি।” তিনি বলেন, “এখন আমরা কর্মসূচি নিয়েই বেশি ব্যস্ত। এজন্য কমিটি করতে পারছি না। দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনক্রমে কমিটি ঘোষণা করা হবে।”
নাম প্রকাশ না করার শর্তে লালবাগ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদপ্রত্যাশী সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতা বলেন, “নানা আন্দোলন-সংগ্রাম করে জেলে গিয়েছি। মামলা-হামলার শিকার হয়েছি। এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করব। কিন্তু সম্মেলনের এক বছর পরও কমিটি দেওয়া হচ্ছে না। নতুনদের আওয়ামী লীগ করার সুযোগ দিচ্ছেন না। স্থানীয়ভাবে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তা করা হয়নি। এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষমতায় থাকার কারণে তা বুঝতে পারছি না। আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হলে সাংগঠনিক দুর্বলতা বোঝা যেত।”