• ঢাকা
  • সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

‘জীবন শিল্পী’ আব্দুল জব্বার স্মরণে


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: আগস্ট ৩০, ২০২৩, ০৮:৪৯ এএম
‘জীবন শিল্পী’ আব্দুল জব্বার স্মরণে

জব্বার সাহেব যেকোনো টিভি ইন্টারভিউ ও অনুষ্ঠানে একটা কথা বারবার বলতেন। তিনি বলতেন, “আমার জীবনে, আমার চার পাঁচ দশকের সংগীত ক্যারিয়ারে, সবচেয়ে স্মৃতিময় অর্জন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কিংবা পুরো ভারতে ঘুরে ঘুরে গান গেয়েছি, মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি, কত বিখ্যাত মানুষদের সাথে মিশেছি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আমাকে যে স্নেহ করতেন তা একাত্তর না এলে সম্ভব ছিল না।”

আব্দুল জব্বার, মূলত বেতারের শিল্পী ছিলেন। ‘নতুন সুর’ সিনেমার জন্য রবীন ঘোষ ভাবলেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর ফেরদৌসি রহমানকে ডুয়েট করাবেন। কেজি মোস্তফা জানালেন, ‘একটা ছেলে আছে হেমন্তের মত গায়।’ ফেরদৌসি রহমান জানালেন, ‘হ্যাঁ বাসায় এসেছিলো আমার, গায় ভালো।’ সেই থেকে শুরু জব্বার সাহেবের সিনেমাতে গান গাওয়া।

আশুতোষের কণ্ঠে ‘শুনো একটি মুজিবরের থেকে’ গানটা শুনেই তিনি আগরতলা আসেন। আগরতলার ছোট রেডিও স্টেশনেই দেশের একটা গান গাইবার সুযোগ পান। এরপরে যা হয় সেটা ইতিহাস। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শুরু থেকেই তিনি ছিলেন, তার গানই প্রথম বাজে, অনুষ্ঠান শুরুর গানও কোরাসের বাইরে তিনি ছিলেন প্রধান শিল্পী।

মুকুল চৌধুরীর লেখা আলম খানের সুরে ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটায়, প্রচুর বাদ্যযন্ত্র ও নানান শব্দের সংমিশ্রণে বানানো। গানটার প্ল্যান ছিল সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজবে। কিছুদিন আগে প্রয়াত নায়ক ফারুক ছিলেন বুদ্ধিমান, তিনি বললেন, তার লিপে থাকতেই হবে গানটা। আবদুল্লাহ আল মামুন ছিলেন পরিচালক, তিনি বোঝালেন অনেক। কিন্তু কাজ হলো না। গান গেল, হিট হলো, কবরী-ফারুকের অভিনয় সবার মন জয় করলো।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুব স্নেহধন্য ছিলেন আব্দুল জব্বার। সবসময় বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করতেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে তিনি সম্বোধন করতেন ‘বাবা’ বলে, আর আবদুল জব্বারকে শেখ মুজিব ডাকতেন ‘গানপাগলা’ বলে। বিভিন্ন সময় সেসব স্মৃতি নিয়ে কথা বলেছেন আব্দুল জব্বার। স্বাধীন দেশ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বহু গান গাওয়া এই শিল্পী ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে এক জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর স্মৃতি কথায় উল্লেখ করেন—

তখন বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে। বাবা (বঙ্গবন্ধু) একদিন আমাকে ডেকে বললেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এমন একটা গান বানা তো পাগলা, যেমন একুশে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে আছে ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। যেই বলা সেই কাজ। বাবার আদেশ পালন করতে ছুটে গেলাম কবি ও গীতিকার ফজল-এ-খোদার কাছে। লেখা হলো মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সেই গান—‘সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে।’ সুর করে গানটি বাবার সামনেই গাইলাম। বাবা বিস্ময়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “কী চাস তুই আমার কাছে? মন্ত্রী হবি?” আমার উত্তর ছিলো ‘না’। বেতারের বড় একটা চেয়ার দিই? এবারেও আমার উত্তর ‘না’। তখন বাবা বলেছিলেন, ‘তাহলে তুই কি চাস?’ উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘আমার এখনো অনেক গান গাওয়া বাকি আছে। আমি সারা জীবন গানই গাইতে চাই।’ বাবা তখন আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘ওরে পাগলা, তুই তাইলে সারাজীবন গানই গা।’

১৯৬৬ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাবিতে উত্তাল সারা দেশ। আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এমন সময় আবদুল জব্বার গেয়ে চলেছেন, ‘আমাদের দাবি যারা মানে না, পিটাও তাদের পিটাও; বন্দী করে যদি ওরা ভাবে খেলা করেছি শেষ, তা হবে মস্ত বড় ভুল।’

মানুষের অধিকার আদায়ের গান গাইতে গাইতেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামালার আসামিও হতে হয়েছিল আব্দুল জব্বারকে। জাতির পিতা আগরতলা মামলা থেকে রেহাই পেয়ে যে কয়জন মানুষের খোঁজ করেছিলেন তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ‘গান পাগলা’ আবদুল জব্বার। তাঁকে দেখলেই বঙ্গবন্ধু বুকে জড়িয়ে নিতেন। দেশপ্রেমী এই শিল্পীকে এতোটাই পছন্দ করতেন বঙ্গবন্ধু। এমন একজন শিল্পীর কণ্ঠেই মানায়— ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি’, ‘মুজিব বাইয়া যাও রে, অকূল দরিয়ায়’, ‘সাত কোটি মানুষের একটাই নাম, মুজিবর’, অথবা ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই’।

এ প্রজন্মের লোকজন আব্দুল জব্বারের গান তেমন শোনে না। ব্যাপারটা হতাশার। আব্দুল জব্বারের গান সব সময় তারুণ্যের। এখনও রিকশায় চলার সময় আমি গুনগুন করে গাই, ‘পিচ ঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি‍‍`। এই গানটাই কি দারুণ কোরাস, ‘দিন যায় রাত যায় এমনি করে, অলিগলি পথ-ঘাট ঘুরে ঘুরে’। গ্লানিময় দিন যাপন শেষে গাইতে ইচ্ছে করে, ‘এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি কেন একা বয়ে বেড়াও?’ দিন যাপনের নানান আশা নিরাশায় গাইতে হয়, ‘তুমি কি দেখেছো কভু’।

নানান অসুখে ভুগে ভুগে এইদিনে তিনি চলে যান। ১৯৮০ সালে পান একুশে পদক। ১৯৯৬ সালে দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পদক। এ ছাড়া আরও অনেক পুরষ্কার তিনি পেয়েছেন। সবচেয়ে বড় পুরষ্কার এই বাংলাদেশের মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা। প্রয়াণ দিবসে সংগ্রামী লাল সালাম জানাই এই যোদ্ধা শিল্পীকে, আর জানাই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

Link copied!