কৃষিতে খ্যাত জেলা পাবনায় এবারও মাঠজুড়ে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে। জেলার সবচেয়ে বেশি আবাদ হচ্ছে পাবনা সদরসহ সুজানগর, সাঁথিয়া, বেড়া, ফরিদপুর উপজেলাতে। জেলায় চলতি মৌসুমে পেঁয়াজের বাম্পার ফলন আশা করলেও বৈরী আবহাওয়া আর বাজারদর চিন্তিত করে তুলেছে চাষিদের।
এবার ফাল্গুনের শুরুতেই কয়েক দফা বৃষ্টি দেখা দিয়েছে। ফলে বালাইনাশক স্প্রে ব্যবহার করার পর বৃষ্টি হওয়ায় আবারও স্প্রে করতে হচ্ছে। এতে কৃষকদের উৎপাদন খরচ যেমন বাড়ছে, তেমনি পেঁয়াজের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাও কম হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া বৃষ্টির কারণে পোকামাকড়ের আক্রমণ, পেঁয়াজগাছের গোড়া পচনসহ নানা রোগবালাই দেখা দিতে পারে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আবারও বৃষ্টির যে পূর্বাভাস রয়েছে, তাতে চাষিদের মধ্যে চিন্তার পরিমাণ বেড়ে গেছে পেঁয়াজের ফলন নিয়ে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, এ বছর জেলায় পেঁয়াজের (হালি) আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৪ হাজার ৪৫ হেক্টর জমিতে, কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৪৪ হাজার ৮১০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। জাতের মধ্যে তাহেরপুরী, ফরিদপুরী, বারি পেঁয়াজ-১, কলসনগর, লালতীর কিং, হাই লালতীর, হাই ইস্পাহানী ও হাই মেটাল জাতের পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। আর গত বছর আবাদ হয়েছিল ৪৪ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে। এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৫১৩ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সুজানগর উপজেলায় আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ হাজার ৫০০ হেক্টর, আবাদ হয়েছে ১৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর। এছাড়া সাঁথিয়ায় ১৫ হাজার ৭০০ এবং বেড়া উপজেলায় ৩ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পাবনার সুজানগরের খয়রান, দুর্গাপুর, ভায়নার, সাঁথিয়ার খিদিরগাঁও, মটকা, ঘুঘুদহ, মুক্তারের মাঠ, আফ্রা মাঠে পেঁয়াজ খেতে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। কেউ কেউ আগাছা তুলছেন, কেউ কেউ দিচ্ছেন বালাইনাশক স্প্রে, কেউবা করছেন বৃষ্টিতে জমে থাকা পানি বের করতে নালা কাটতে।
দুর্গাপুরের চাঁদ আলী মণ্ডল এবার ২৫ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করেছেন। গতবার লাভের মুখ দেখলেও এবার দাম ও ফলন নিয়ে তিনিও চিন্তায় আছেন। তিনি বলেন, “গতবার বীজের দাম বেশি হলেও উৎপাদন ও বাজারদর ভালোই পেয়েছিলাম, কিন্তু এবার কী হয় সেটাই দেখার বিষয়। এবার মুড়ি কাটা পেঁয়াজের যে দাম গেল তাতে আমাদের হালি পেঁয়াজের দাম কেমন হবে, তা নিয়েই আশঙ্কায় আছি। এরপর আবার আবহাওয়ার অবস্থাও ভালো দেখা যাচ্ছে না।”
কৃষিতে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ভায়না গ্রামের মোহাম্মদ কামরুজ্জামান প্রামাণিক বলেন, “এবার পেঁয়াজ আবাদ করেছেন ২০ বিঘা। এক বিঘা জমিতে কীটনাশক খরচ ৩ হাজার টাকা, সার ও চাষ বাবদ ৫ হাজার টাকা। শ্রমিক খরচ ১৫ হাজার টাকা। আর জমি ইজারা নিতে হয় ২০ হাজার টাকা দিয়ে। সব মিলিয়ে বিঘাপ্রতি ৪০ হাজার টাকার ওপরে খরচ হচ্ছে। এবার এভাবে বৃষ্টি হলে ফলন হতে পারে ৩০ থেকে ৪০ মণ। আর বাজারদর যদি ৭০০-৮০০ বা হাজারের কাছাকাছি থাকে, তাহলে ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে। আর ফলন ও দাম ভালো থাকলে কিছুটা লাভের আশা করা যায়।”
পেঁয়াজচাষিদের দাবি, প্রতিবারই সরকার বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে। কিন্তু এবার আমদানি কিছুটা কমিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে যদি সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করে, তাহলে দেশের মানুষ ও কৃষকরাও ব্যাপক লাভবান হবে।
পেঁয়াজক্ষেতের শ্রমিক ছবেদ প্রামাণিক, আনিসুল, রাসেল, সালাম, মোমিন, কেরামত, উজ্জ্বল, বাপ্পি, জুয়েলসহ বেশ কয়েকজন বলেন, ৬০০-৭০০ টাকা হাজিরায় পেঁয়াজক্ষেতে কাজ করেছি। কিন্তু এখন কমে ৪০০ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ প্রতিদিন হুহু করে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। এই হাজিরায় সংসার চালানো আর সন্তান মানুষ করা দায় হয়ে পড়েছে। পেঁয়াজের দামের সঙ্গে আমাদের হাজিরার সম্পর্ক। পেঁয়াজের দাম বাড়লে একদিকে চাষি লাভবান হবে, অন্যদিকে আমরাও চড়া হাজিরা পেয়ে কাজ করতে পারব।
সুজানগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাফিউল ইসলাম বলেন, “অসময়ে বৃষ্টিতে হয়তো চাষিদের বাড়তি পরিচর্যা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত যে বৃষ্টি হয়েছে সেটায় চাষিদের তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। এবার আমাদের কৃষি অফিস সার-বীজসহ অন্যান্য উপকরণ দিয়ে কৃষকদের সহযোগিতা করেছে। ফলনও আশা করছি ভালো হবে।”
তবে সামনে যদি আবহাওয়ার কোনো দুর্যোগ দেখা দেয়, তাহলে কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়বেন এমন শঙ্কার কথা জানালেন কৃষি কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, “পেঁয়াজের বাজার যথেষ্ট ভালো আছে। বাজার পরিস্থিতি এভাবে থাকলে অবশ্যই কৃষক লাভবান হবেন। আমরা কৃষি বিভাগ সার্বক্ষণিকভাবে কৃষকদের পাশে থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছি। কৃষকদের উৎপাদন ক্ষতি কমাতে বিভিন্ন উপকরণ ও পরামর্শ দিয়ে আসছি। আশা করছি ফলনও ভালো হবে।
উৎপাদিত কৃষিপণ্য সংরক্ষণের বিষয়ে তিনি জানান, এবার সংরক্ষণ করে আমরা সারা দেশে পাবনা থেকে পেঁয়াজ সরবরাহ করব এমনটি ভাবনা নিয়ে ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চলছে। পাবনায় অত্যাধুনিক সংরক্ষণাগার স্থাপনের বিষয়ে চেষ্টা চলছে।