• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বাস্থ্য সেবাবঞ্চিত উত্তরের চরাঞ্চলের মানুষ


কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৭, ২০২৩, ১০:১০ এএম
স্বাস্থ্য সেবাবঞ্চিত উত্তরের চরাঞ্চলের মানুষ
সদর উপজেলার ঝুনকার চর কমিউনিটি ক্লিনিক

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদ বিচ্ছিন্ন জনপদ মশালের চর। গর্ভাবস্থার জটিলতা নিয়ে তিন মাস আগে বিনা চিকিৎসায় মারা যান এই চরের বাসিন্দা ২২ বছরের সাজেদা বেগম। মশালের চর থেকে নৌকায় করে সাজেদাকে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়। সাজেদার গর্ভের সন্তানও বাঁচেনি।

কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত চরগুলোতে বেহাল স্বাস্থ্যসেবা শিকার হচ্ছেন সাজেদার মতো অসংখ্য মানুষ। জেলায় চার শতাধিক চরের মধ্যে মাত্র ৫০টিতে কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। প্রায় ৩৫০ চরে নেই কমিউনিটি ক্লিনিক। আবার যেসব চরে কমিউনিটি ক্লিনিক আছে, সেখানেও চিকিৎসা সরঞ্জাম ও মানবসম্পদের ব্যাপক সংকট রয়েছে। ফলে গুরুতর পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত হচ্ছেন চরের মানুষ।

সাজেদার মা নাসিমা বেগম জানান, ২০ জুন সকালে সাজেদার প্রসব বেদনা ওঠে। সে সময় নাসিমা বেগম অন্যের বাসায় কাজে ছিলেন। মেয়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে তিনি বাসায় ফিরে স্থানীয় দাই বেমলা বেগমকে খবর দেন। তবে দিনভর চেষ্টা করে বিকেলে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান বেমলা। এরপর পল্লি চিকিৎসক এসে ব্যথার ইনজেকশন দিলে সাজেদার প্রসব বেদনা তীব্র হয়, তবে সন্তানের জন্ম হয়নি। সন্ধ্যার পরে পল্লি চিকিৎসক জানান, সাজেদা বেগমের সন্তান উল্টে আছে। তাই দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। তার পরামর্শে রাত ৮টার পরে সাজেদাকে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে নৌকার বন্দোবস্ত করে কুড়িগ্রামে হাসপাতালে নেওয়ার পথে সাজেদা মারা যান।

নাসিমা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, “আমাগো চরের মানুষের কপাল খারাপ। গর্ভবতী নারীর জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হইলে শহরের হাসপাতালে নিতে হয়। এলাকায় চিকিৎসা নাই। আমাগো চর গ্রাম থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে হাসপাতাল, পৌঁছাতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। এর মধ্যে কেউ বাঁচে না।”

সদরের ঝুনকার চরের বাসিন্দা আশরাফুল আলম জানান, তার দুই মেয়ের একজনের বয়স ৬ বছর, আরেকজনের তিন বছর। তিনি বলেন, “আমার বউ যখন গর্ভবতী তখন ক্লিনিক (কমিউনিটি ক্লিনিক) থেকে কোনো ডাক্তার দেখে নাই। খালি আয়রন আর ভিটামিনের বড়ি দিছিল। দুই মেয়ে হওয়ার সময়েই দুই ঘণ্টা নদী পার হয়ে কুড়িগ্রাম নিয়া গেছি।”

সদর উপজেলার ঝুনকার চার কমিউনিটি ক্লিনিক অধিকাংশ সময় থাকে তালাবদ্ধ

চরাঞ্চলের বাসিন্দারা জানান, কুড়িগ্রাম জেলায় চার শতাধিক চরের মাত্র ৫০টি চরে কমিউনিটি ক্লিনিক থাকলেও সেখানে গেলে বেশির ভাগ সময় চিকিৎসক বা ওষুধ মেলে না। সপ্তাহে এক-দুই দিন কমিউনিটি মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট পদের চিকিৎসক সেসব ক্লিনিকে যান। এসব ক্লিনিকে জ্বর, সর্দির প্যারাসিটামল, মেট্রো ট্যাবলেট এবং স্যালাইন ছাড়া আর কোনো ওষুধ পাওয়া যায় না।

জেলা সিভিল সার্জন অফিসের তথ্যমতে, একটি কমিউনিটি ক্লিনিকে ২৭ ধরনের ওষুধ থাকার কথা। আসবাব ও সরঞ্জাম হিসেবে একটি করে চেয়ার, টেবিল, আলমারি, বিপি মেশিন, বালতি, মগ, বদনা, ওজন মাপার মেশিন, আর গ্লুকোমিটার থাকবে। সপ্তাহের শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত কমিউনিটির স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যাবে।

তবে বাস্তব চিত্র একেবারেই আলাদা। জেলার চরাঞ্চলে ঘুরে দেখা গেছে, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি তো আছেই, সেই সঙ্গে দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক বা কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডারকে (সিএইচসিপি) সপ্তাহে দু-এক দিন ছাড়া পান না স্থানীয়রা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে গচ্ছিত রাখা হয়েছে ক্লিনিকের চাবি আর ওষুধ বিতরণের দায়িত্ব।

সদর উপজেলার ঝুনকার চর কমিউনিটি ক্লিনিকের পাশেই বাসা কুলসুম বেগমের। জুলাই মাসে তার দ্বিতীয় সন্তান প্রসব হওয়ার কথা ছিল। প্রসব যন্ত্রণা উঠলেও বাড়ির পাশের কমিউনিটি ক্লিনিকে তিনি যেতে পারেননি। সেদিন ক্লিনিক খোলা থাকার কথা থাকলেও ছিল বন্ধ। 
দুপুরে কুলসুমের হঠাৎ প্রসব ব্যথা উঠলে চাচাশ্বশুর আব্দুল মালেক ক্লিনিকের সিএইচসিপি মিজানুর রহমানকে ফোন দেন। মিজানুর রহমান জানান, তিনি শহরে প্রশিক্ষণে আছেন। এরপর স্থানীয় দাই দিয়ে প্রসব করানোর পর কুলসুমের দ্বিতীয় সন্তানটি মারা যায়।

এই ক্লিনিকটিতে আগস্ট মাসের মধ্যভাগে সোম, মঙ্গল ও বুধবার পরপর তিন দিন গিয়ে বন্ধ পাওয়া গেছে। পরে মোবাইল ফোনে সিএইচসিপি মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমি সপ্তাহে বন্ধের দিন ও শনিবার থেকে মঙ্গলবার ছাড়া প্রায় সব দিন যাওয়ার চেষ্টা করি। অফিসে নিয়মিত উপস্থিত থাকার চেষ্টা করি। তবে নৌকা ছাড়া যেতে পারি না, ওই এলাকার যোগাযোগব্যবস্থা খুব খারাপ।”

আশপাশের লোকজন রুটিন করে চাবি গচ্ছিত রেখে ক্লিনিকটি খোলা রাখছেন, তারাই আবার ওষুধ বিতরণের দায়িত্ব পালন করেন। এখানে মোয়াজ্জেম হোসেন নামে একজন হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্টের দায়িত্ব পালনের কথা থাকলেও সেবা দিতে না আসার কারণে স্থানীয়রা তাকে চেনেন না।

সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ার চরের বাসিন্দা শাহিনা আক্তার বলেন, “হামার চর ও আশপাশের চর মিলে কয়েক হাজার মানুষ থাকে। কিন্তু এখানে কোনো কমিউনিটি ক্লিনিক নাই। লোকজন শহরে গিয়ে ডাক্তার দেখায়। আর ছোটখাটো অসুখ হলে ওষুধের দোকান থেকে নিজের মতো বড়ি কিনে আনি খায়। ক্লিনিক থাকলে এই কষ্ট আর করা লাগত না।”

চিলমারী উপজেলার অষ্টমীচর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য মোকরম আলী বলেন, “চরের মানুষের ডাক্তারের সেবা পাওয়া খুব কষ্টের। খুব বড় সমস্যা হলে নদী পার হয়া শহরে নিয়া যাওয়া লাগে। একটা ইউনিয়নে তিনটা ক্লিনিক থাকার কথা থাকলেও, অনেক জায়গার অবস্থা খারাপ। দু-একটা যেটা আছে সেখানেও ডাক্তার পাওয়া যায় না সব সময়।”

চরাঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, গুটিকয়েক কমিউনিটি ক্লিনিকে সপ্তাহে নিয়মিত সেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে সেখানেও রয়েছে সংকট।

রাজীবপুর উপজেলার ঢুষমারা থানার কটিয়ার চর কমিউনিটি ক্লিনিকটি নিয়মিত খোলা থাকলেও রয়েছে নানা সংকট

রাজীবপুর উপজেলার ঢুষমারা থানাধীন কটিয়ার চর কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, একজন পুরুষ সিএইচসিপি দিয়ে চলছে ক্লিনিকটি। ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন এই চরে স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র এই একটিই। এখানে নিয়মিত চরের বাসিন্দারা স্বাস্থ্যসেবা নিলেও কিশোরী ও নারীরা পড়ছেন বিপাকে। বিশেষ করে পুরুষ সিএইচপিকে চরের অনেক কিশোরী লজ্জার কারণে বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা এবং নারীরা নিজেদের মাতৃত্বকালীন জটিলতা বলতে পারেন না। এই ক্লিনিকে প্রতিদিন গড়ে ২৫ জন মানুষ ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি, গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবাসহ ছোটখাটো স্বাস্থ্যগত বিষয়ে এখানে সেবা নিচ্ছেন। এখানে বিনামূল্যে ২৭ প্রকারের ওষুধ সরবরাহ করতেও দেখা গেছে।

ক্লিনিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিএইচসিপি মো. মাসুদ ইকবাল বলেন, “আমার ক্লিনিকে সব ধরনের ওষুধ রয়েছে। লোকজন প্রতিদিন আসেন চিকিৎসা সেবা নিতে। তবে মহিলারা একটু সংকোচবোধ করেন। এখানে জনবল সংকট রয়েছে। একজন হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্টের দায়িত্ব থাকলেও কোনো মাসে পাওয়া যায়, কোনো কোনো মাসে তাকে পাওয়াই যায় না।”

এই ক্লিনিকে সেবা নিতে আসা সাহিদা আক্তার বলেন, “ছোট বাচ্চাটার কয়েক দিন থেকে জ্বর ও কাশি। এখান থেকে বিনা মূল্যে ওষুধ নিলাম। কিন্তু আমাদের (নারীদের) কিছু বিষয় আছে এনাকে বলতে পারি না। মহিলা ডাক্তার থাকলে ভালো হতো।”

দীর্ঘদিন ধরে চরের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করা স্থানীয় সংগঠন ‘সারথি’-এর প্রতিষ্ঠাতা জাহানুর রহমান খোকন বলেন, “চর এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি চরের মানুষের উন্নত চিকিৎসা সুবিধার অভাব পূরণের জন্য বছরব্যাপী ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা ক্যাম্প চালানো প্রয়োজন। সেই সঙ্গে জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় এনে পাশাপাশি কয়েকটি চর মিলে একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হলে এসব অঞ্চলের মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে।”

জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মঞ্জুর এ মুর্শেদ বলেন, “প্রতিদিন অফিসে যাওয়া একজন সিএইচসিপির মৌলিক দায়িত্ব। যারা দায়িত্বে অবহেলা করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আর চরগুলোতে স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি নিরসনে আরও কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের জন্য আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছি।”

Link copied!