বরগুনার উপকূলীয় অঞ্চলে জেলেদের জীবন দাদন প্রথার ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে। শত শত বছর ধরে চলে আসা এই অগ্রিম অর্থ প্রদানের প্রথা আজ আধুনিক বরগুনার মৎস্যজীবীদের জীবনের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যারা সাগরে জীবন বাজি রেখে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন, তারা আজও অর্থনৈতিক মুক্তি পায়নি। বছর শেষে কোটি টাকার মাছ শিকার করলেও পরিবর্তন আসেনি তাদের ভাগ্যে। তাদের এই বঞ্চনার অন্যতম প্রধান কারণ—দাদন প্রথা।
জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বরগুনার প্রতি ১০০ জন জেলের মধ্যে ৯৫ জনই দাদনের ফাঁদে আটকে রয়েছেন। এর মধ্যে ৮০ জন জেলে শ্রমের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেকে পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন, আবার অনেকে প্রস্তুতি নিচ্ছেন এই পেশা ত্যাগের করে অন্য পেশায় জীবনযাপন করবেন।
উপকূলীয় অঞ্চলের হাজারো জেলের জীবনে টিকে থাকা এখনই বড় চ্যালেঞ্জ। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অন্যদিকে মহাজনের চক্র—এই দুইয়ের চাপে তারা দিশেহারা। টেকসই ও ন্যায়সংগত মৎস্যনীতি বাস্তবায়নই পারে এই সম্ভাবনাময় খাতকে রক্ষা করতে। এখন প্রয়োজন কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারের একসঙ্গে কাজ করা। না হলে, দাদনের এই শেকলেই হারিয়ে যাবে বরগুনার জেলেদের জীবন ও স্বপ্ন।
দাদনের এই ফাঁদ শুধু সাগরের জেলেদের নয়, নদ-নদীর জেলেদের জীবনেও ছায়া ফেলেছে। তারা ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত দাদন নিয়ে মাছ ধরেন এবং বাধ্য হয়ে নির্দিষ্ট আড়তে কাছেই মাছ বিক্রি করেন। হাক-ডাকে তারা এই মাছ বিক্রি করতে পারে না। কম টাকায় কিনে রাখেন দাদনের টাকা দেওয়া ওই আড়তে।
৭২ বছরের জেলে মো. আলম ফিটার বলেন, “মাত্র ১০ বছর বয়সে বাবা আজম আলীর সাথে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে যাই। তখন শক্তি ছিল না জাল টানার, তাই মাছ ছুটিয়ে বরফ দেওয়ার কাজ করতাম। এত বছরেও কিছুই পাল্টায়নি জীবনের। প্রতি বছরই ঝড়ের কবলে পড়তে হয় গভীর বঙ্গোপসাগরে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে জীবিকারের তাগিদায় যেতে হয় মাছ ধরতে। ট্রলার মালিক এবং আড়তদারের ভাগ্য পরিবর্তন হলেও আমাদের মতন জেলি কিংবা মাঝি ঘাড়ে রয়ে গেছে দাদনের বোঝা।”
ট্রলারের মাঝি সোহায়েল হোসেন বলেন, “দাদন নিয়ে মাছ শিকার করতে হয়, আর চুক্তি অনুযায়ী যা মাছ ধরি, সব দিতে হয় আড়ৎদারকে। দাম নির্ধারণ করেন তিনিই, আমাদের কোনো কথাই চলে না।”
ট্রলার মালিক রাশেদুজ্জামান রাসেল বলেন, “আমরাই তো তাদের পেছনে বিনিয়োগ করি। এর মধ্যে ঝুঁকিও থাকে অনেক বেশি। দুই লাখ টাকা খরচ করে নৌকা পাঠানোর পর অনেক সময় দেখা যায়, তারা পঞ্চাশ হাজার টাকার মাছও আনতে পারেনি। ফলে এই ক্ষতিটা আমাদেরই নিতে হয়। সাগরে যাওয়ার আগে জেলেদের যে টাকা আমরা দেই, সেই টাকা তারা কখনো শোধ করতে পারে না। এতে আমাদের অনেক ক্ষতিও হয়। তারপরও আমরা জেলেদের কাছে টাকা শোধ করার জন্য কোনো চাপ দেই না। জেলেদের দস্যুরা অপহরণ করলে আমরাই চাঁদা দিয়ে তাদের ফিরিয়ে আনি। সেই টাকা জেলেদের পরিবারের কেউ কখনো শোধ করে না। কেউ বলতে পারবে না—টাকার জন্য আমরা জেলেদের দস্যুদের কাছ থেকে মুক্ত করে আনি না। জেলেদের সুখে দুখে আমরা মালিকপক্ষ সব সময় তাদের পাশে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করি।”
ট্রলার মালিক সেলিম খান বলেন, “২০১৬ সালে দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করেন ট্রলার এফবি বাপ্পি। লাভের আশায় সাগরে গেলেও বারবার ক্ষতির মুখে পড়েন তিনি। বাধ্য হয়ে তিনি দাদনের পথে হাঁটেন।”
বাংলাদেশ মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, “সাগরে মাছ কমে যাওয়ায় জেলে ও ট্রলার মালিকরা লোকসানে পড়ছেন। কোনো ব্যাংক বা এনজিও ঋণ না দেওয়ায় দাদনই একমাত্র ভরসা।”
অর্থনীতিবিদ ড. শহিদুল জাহিদ বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে রিফাইন্যান্স ফান্ড গঠন করে উপকূলীয় জেলেদের স্বল্পসুদে ঋণ দিতে পারে। এতে করে তারা মহাজনের দাদনের ওপর নির্ভর না করে স্বাধীনভাবে মাছ শিকার করতে পারবে। জেলেদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ এদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের জেলেদের পাশে এগিয়ে আসা উচিত।”
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসীন বলেন, “জেলেদের স্বাবলম্বী করতে বিনামূল্যে বকনা বাছুর, ছাগল ও খাবার দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। তবে নগদ অর্থ সহায়তার কোনো ব্যবস্থা নেই। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা এই বিষয়গুলো তুলে ধরব এবং জেলেদের মাথার উপর যে দাদনের বোঝা চেপে আছে সেটা থেকে মুক্তি করার চেষ্টা করব। আমরা সব সময়ই জেলেদের সুখে দুখে পাশে থাকি।”
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, “মৎস্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে দাদন প্রথা বন্ধে কার্যকরী পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। উপকূলীয় অঞ্চলের জেলেরা যাতে সরকারি ভাবে আর্থিক সহায়তা পায়।”
                
              
																
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    




































