ইরানে ইসরায়েলি হামলা কি বৈধ?

সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক প্রকাশিত: জুন ২০, ২০২৫, ০৪:৪৫ পিএম
ইরানি রেড ক্রিসেন্টের উদ্ধারকারী দলের সদস্যদের তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি ভবনের ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করতে দেখা যাচ্ছে। ছবি: এএফপি

ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংসে সামরিক অভিযানে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইসরায়েল দাবি করছে, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তাই আত্মরক্ষার অংশ হিসেবে আগাম হামলা চালানো হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের আলোকে প্রশ্ন উঠেছে—এই হামলা কি বৈধ?

জাতিসংঘ সনদ কী বলে?

জাতিসংঘ সনদ অনুসারে, কোনো রাষ্ট্র কেবলমাত্র আত্মরক্ষার জন্য বা নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদনে সামরিক পদক্ষেপ নিতে পারে। যখন আলোচনা ও কূটনীতির সব পথ ব্যর্থ হয়, তখনই শুধু প্রতিরক্ষামূলক হামলা বৈধ হয়।

ইসরায়েল এই প্রেক্ষাপটে দাবি করছে, তারা ‘আগাম আত্মরক্ষার’ অধিকার প্রয়োগ করছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনবিদদের মতে, এই ধারণার প্রয়োগ খুব সীমিত এবং কঠোর প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল।

বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি

আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক ও ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ইন্টারন্যাশনাল ল’–এর সম্পাদক মার্কো মিলানোভিচ বলেন, ইসরায়েলের হামলা কোনো সরাসরি বা আসন্ন ইরানি আক্রমণের প্রতিক্রিয়া নয়।

তিনি লিখেছেন, “এখন পর্যন্ত এমন কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই যে ইরান অপ্রতিরোধ্যভাবে ইসরায়েলের ওপর পারমাণবিক হামলা চালানোর পরিকল্পনায় অগ্রসর হয়েছে।”

অ্যাথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মারিয়া গাভোনেলি বলেন, “অগ্রিম আত্মরক্ষার আইনি ভিত্তি কেবলমাত্র তখনই গ্রহণযোগ্য, যদি প্রমাণ থাকে যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি হচ্ছে এবং তা ব্যবহারের আশঙ্কা ত্বরান্বিত।”

আইএইএ কী বলেছে?

জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা (আইএইএ) জানিয়েছে, তারা ইরানে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের কোনও প্রমাণ পায়নি। সংস্থার প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বলেছেন, “আমরা এখনও এমন কোনও পরিকল্পনার প্রমাণ পাইনি যা নির্দেশ করে ইরান পারমাণবিক অস্ত্রে প্রবেশ করেছে।”

তবে তিনি বলেছেন, ইরান তাদের পরিদর্শন ও রিপোর্টিং বাধ্যবাধকতা মেনে চলছে না, যা তদারকির ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা।

অতীতে এমন ঘটনা ঘটেছে?

১৯৮১ সালে ইসরায়েল ইরাকের অসমাপ্ত পারমাণবিক চুল্লি ‘ওসিরাক’ ধ্বংস করেছিল একই যুক্তিতে। কিন্তু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এই হামলাকে জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে।

২০০৩ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশও ‘প্রি-এম্পটিভ সেলফ ডিফেন্স’ তত্ত্ব তুলে ধরে ইরাকে যুদ্ধ চালান, যদিও সেখানে অস্ত্রের অস্তিত্ব ছিল না।

বেসামরিক স্থাপনায় হামলার বৈধতা কতটুকু?

বৃহস্পতিবার ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের সোরোকা মেডিকেল সেন্টারে প্রায় ৭০ জন আহত হন। ইরান বলছে, হাসপাতালের পাশে একটি সামরিক স্থাপনাই ছিল লক্ষ্যবস্তু।

অন্যদিকে, ইসরায়েল গাজা ভূখণ্ডে ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধে অধিকাংশ হাসপাতাল ধ্বংস করেছে, দাবি করেছে যে হামাস সেগুলো ব্যবহার করছিল।

রেড ক্রসের মতে, হাসপাতাল ও চিকিৎসা স্থাপনাগুলো যুদ্ধবিধি অনুযায়ী বিশেষ সুরক্ষিত এবং সেগুলোর ওপর হামলা করা স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ।

মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে হামলা

ইসরায়েল সম্প্রতি ইরানি রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার সংস্থা আইআরআইবি-এর ভবনে হামলা চালিয়েছে। এর আগে গাজায় আল জাজিরা ও এপির অফিস ধ্বংস করা হয়েছিল। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় ২০০ জনের বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।

যদিও সাংবাদিকদের জন্য আলাদা সুরক্ষা নেই, তারা আন্তর্জাতিক আইনে সাধারণ বেসামরিক নাগরিক হিসেবে সুরক্ষিত।

আইন ও বাস্তবতার বিচারে ইসরায়েলের ইরানে সামরিক অভিযান, বিশেষ করে পারমাণবিক স্থাপনা, হাসপাতাল ও সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করা, আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।