১.. সৈয়দ শামসুল হক নানা সূত্রে হঠাৎ আসতেন আমার কর্মস্থল চ্যানেল আইতে। চ্যানেল আইয়ের তিনি ছিলেন একজন অভিভাবক। অনেক সময় বড় ইভেন্টের সূত্রে তাঁকে আসতে হতো। এ ছাড়া নানা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনেও হঠাৎ হঠাৎ চ্যানেল আই-এ আসতেন তিনি। কখনো কখনো আনোয়ারা সৈয়দ হকও সঙ্গে থাকতেন। বছরদুয়েক আগে একটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠানও শুরু করেছিলেন তিনি। নাম ‘বইয়ের কথা বলছি’। এই অনুষ্ঠানটির সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম বলে তাঁর সঙ্গে আমার উপস্থিতিও ছিল আবশ্যিক। একেকটি বই নিয়ে পাঁচ মিনিট কথা বলতেন তিনি। অনুষ্ঠানটির পরিসর কম হলেও অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল এর অভিনবত্বের কারণে। প্রতিটি পর্বের শুরুতে ক্যামেরার সামনে সোফায় বসা অবস্থায় তিনি বলতেন, ‘প্রিয় দর্শক টিভির সুইচ বন্ধ করবেন না, রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টিপে চ্যানেল বদল করবেন না। মাত্র পাঁচ মিনিট সময় নেব আমি। একটি বইয়ের কথা বলব।’ তার পর সোফা থেকে উঠে এসে দাঁড়াতেন একটা রস্ট্রামের সামনে। তারপর বলে যেতেন একটা বইয়ের পরিচয়। বইয়ের বিষয় ও লেখক নির্বাচন করতেন তিনি নিজে। কখনো বাড়ি থেকে নিজের পড়া বই সঙ্গে নিয়ে আসতেন, কখনো বা বইয়ের নাম উল্লেখ করে আমাদের বলতেন সংগ্রহ করে দিতে। এই উপলক্ষে একসময় বেশ অল্প ব্যবধানে আসতেন চ্যানেল আইয়ে। তাঁর আসা মানে আমীরুল ইসলামের কক্ষে আড্ডায় মজে যাওয়া। বহুদিন দীর্ঘ আড্ডায় পড়ে গেছেন আমাদের সঙ্গে। তিনি এলে আমার ডাক পড়া ছিল আবশ্যিক! এমনি একদিনের আড্ডায় আমীরুল ইসলামের কক্ষে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি তো লন্ডনে মোটামুটি থিতু হয়েছিলেন। লন্ডন এক অর্থে সারা পৃথিবীর কেন্দ্র। ঐ রকম জায়গায় একবার কেউ গিয়ে থিতু হয়ে বসলে সাধারণত মানুষ বাংলাদেশের মতো সংকটাপন্ন দেশে ফিরে আসতে চায় না। আপনি তাহলে দেশে ফিরে এলেন কেন? আপনার বন্ধুদের অনেকেই ফিরে আসেন নি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও তো ভালো ছিল না! তিনি একটু হাসলেন, তারপর বললেন,
‘‘আমাদের দেশের মতো জায়মান দেশের লেখকদের দেশে থাকাটা জরুরি। আমি তাই লন্ডনে বিবিসির সঙ্গে চুক্তিটা নবায়ন করি নি। একেবারে বাড়ি-গাড়ি বিক্রি করে দেশে ফিরে এসেছি! ফিরে যাবার কোনো পিছুটান রেখে আসি নি। ছেলেমেয়েরা সবসময় বলে ওখানে গিয়ে দীর্ঘ সময় থাকতে। তাও থাকি না।’’
--৪ জুন ২০১৪, স্থান: চ্যানেল আই কার্যালয়ে আমীরুল ইসলামের কক্ষ
২.. আনোয়ারা সৈয়দ হকের নেতৃত্বে ‘অশ্রুপাত’ নামে কয়েক বছর ধরে একটি অনানুষ্ঠানিক সাহিত্য আসর পরিচালিত হয়। তাঁর আহ্বানে আমি যেতে শুরু করি। হাসান আজিজুল হক, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মহবুব তালুকদার, জাহানারা নওশিনের মতো দেশের প্রবীণ সাহিত্যিকদের কেউ কেউ সেখানে আসেন মাঝে মাঝে। প্রায় প্রতিটি আসরেই সৈয়দ শামসুল হক থাকতেন। ‘অশ্রুপাতে’র আসর নিয়ে বিস্তারিত হয়তো কখনো লিখব। এখানে কেবল সৈয়দ শামসুল হক প্রসঙ্গেই বলছি। আসরে আমরা যাঁরা অংশ নিতাম তাঁরা অধিকাংশই তরুণ। আনোয়ারা সৈয়দ হক বয়সে প্রবীণ হলেও উৎসাহে-চঞ্চলতায় তরুণদের মতোই। আসরের নিয়ম অনুসারে সৈয়দ হকের অংশগ্রহণের শর্ত ছিল তিনি অধিকাংশ সময় নিরব থাকবেন। কিন্তু দেখা যেত অনেক সময়ই তারুণ্যের উদ্দীপনায় কিছুটা বিশৃঙ্খলতা দেখা দিত। তখন সৈয়দ হক অনেকটা জাতীয় সংসদের স্পীকারের মতো অবতীর্ণ হতেন। আসরের একেবারে শেষের দিকে প্রশ্ন তুলতেন পঠিত রচনার নানা দিক নিয়ে। কথাও বলতেন দু-একটি। একটি কথার হয়তো পুনরাবৃত্তি করতে হতো তাঁকে। সেটা হচ্ছে রচনার মধ্যেকার মিস্তিরিগিরির দিক। তিনি বলতেন, যিনি শিল্পী তিনি শিল্পের বিষয়বস্তুর কাছে পৌঁছে যাবেন তাঁর প্রতিভার গুণে। কিন্তু একটি রচনার সৌষ্ঠবকে সুন্দর ও যৌক্তিক করে তুলতে হলে লেখকের এক ধরনের মিস্তিরিগিরি করতে হয়। এর ওপর নির্ভর করে সফলতার মাত্রা। একজন শিল্পীর অসাধারণ বিষয়বস্তু মার খেয়ে যেতে পারে মিস্তিরিগিরিতে দুর্বলতার কারণে। এ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে দরকার অনুশীলন। এ প্রসঙ্গে তিনি মার্জিনে মন্তব্য বইয়েও লিখেছেন। কিন্তু সেখানে আমরা পেয়েছি তত্ত্ব। ‘অশ্রুপাতে’র আসরে আমরা পেতাম ‘মিস্তিরিগিরি’র অনুশীলন।
৩.. ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত হয় আমার সম্পাদিত বই-সমালোচনার কাগজ বইয়ের জগৎ পত্রিকা। কেবল বাংলাদেশের বিচিত্র বিষয়ের ও নানা ধরনের বইয়ের সমালোচনা এখানে ছাপা হয়। প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হলে এর মান নিয়ে আমি সন্তুষ্ট হতে পারি নি। কিন্তু আজিজ মার্কেটের বিভিন্ন দোকানে রেখেছিলাম। পাঠিয়েছিলাম চট্টগ্রাম রাজশাহী বগুড়া সহ ঢাকার বাইরের কয়েকটি জায়গায়ও। পত্রিকাটি বের হবার পরে কয়েকজনের সপ্রশংস টেলিফোন পেয়ে আমি অনুপ্রাণিত বোধ করি। সে-সব ফোনের কথা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। বইয়ের জগৎ প্রকাশের মাস দেড়েক পরে তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে দৈনিক সমকাল পত্রিকার সাময়িকী কালের খেয়ার শহীদুল ইসলাম রিপনের সঙ্গে আলাপচারিতায় বাংলাদেশের সমালোচনা-সাহিত্যের দৈন্যের কথা স্বীকার করেও আশাবাদী হয়ে আমার নাম উল্লেখ করেছিলেন এই বলে যে, আমার এই উদ্যোগ সমালোচনার শক্তি বাড়াবে। তিনি বলেছিলেন,
‘‘হ্যাঁ, সমালোচনা সাহিত্য নেই আমাদের দেশে। এখন যেটা হয় সেটা হচ্ছে হয় স্তুতি না হয় নিন্দা। একবার যদি কারও সম্পর্কে একটা মূল্যায়ন হয়, তার সম্পর্কে আর কখনোই পুনর্মূল্যায়ন হয় না। সমালোচনা সাহিত্য সত্যিকারের অর্থে ঋদ্ধ থাকলে আমাদের সাহিত্য আরো এগুতো। এটা আমাদের এক ধরনের সংকীর্ণতা, উদাসীনতা এবং স্বার্থপরতা। আমরা বিজ্ঞাপনে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছি, যার জন্য মোড়ক উন্মোচন, গ্রন্থ প্রকাশ উৎসব ইত্যিাদি করি। এতে করে স্তুতিই করা হয়, মননশীলতার চর্চা হয় না। তবে আশার কথা আহমাদ মাযহারকে আমি পছন্দ করেছি, সে সমালোচনা বিষয়েই একটা পত্রিকা করেছে।...’’
--'কালের খেয়া', দৈনিক সমকাল, ২৫ ডিসেম্বর, ২০০৯
নিজের সম্পর্কে সৈয়দ হকের মূল্যায়ন জানাবার জন্য এই প্রসঙ্গের অবতারণা নয়, আমার উদ্দেশ্য তরুণ লেখকদের সম্পর্কে তাঁর খোঁজখবর রাখবার ধরন কেমন সে-কথা জানানো। কালের খেয়ায় তাঁর মন্তব্য সম্পর্কে অন্যদের কাছ থেকে শুনে সেটা সংগ্রহ করি। কয়েক দিন পরে তাঁর সঙ্গে দেখা হলে আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি স্মিত হাসলেন। বললেন, ‘তরুণ লেখক-সাহিত্যিকেরা কে কোথায় কী করছে তার খোঁজ রাখতে হয়, এজন্য আমার নেটওয়ার্ক আছে। পরে অন্যসময় টুকটাক কথার ফাঁকে তিনি আমাকে বলেছিলেন, সাহিত্য চর্চা একটা চলমান সার্বক্ষণিক প্রক্রিয়া। এর জন্য সবসময় সক্রিয় থাকতে হয়। পড়তে হয় নতুন লেখকদের। সাহিত্যের গতিপ্রকৃতির খোঁজ না করলে লেখক নিজেকে এগিয়ে নেবেন কী করে!
তিনটি ছোট্ট স্মৃতিটুকরোর মধ্য থেকেও হয়তো আভাসিত হবে যে সাহিত্য নিয়েই আবর্তিত হয়েছে তাঁর ভাবনাজগৎ। জীবিকার জন্যে নির্দিষ্ট পেশা গ্রহণ না করে বিচিত্র ধরনের কাজ তিনি করেছেন। সে প্রয়োজনে নানা আপোষও হয়তো তাঁকে করতে হয়েছে। আধুনিকতার দিকে অনগ্রসর একটি সমাজে তাঁকে বাঁচতে হয়েছে বলে এমন অনেক আচরণ তাঁকে করতে হয়েছে যা সমাজের নানা কাঠামোগত দিক থেকে অসঙ্গতির নির্দেশক। এর মধ্যে কোনটি তাঁর চৈতন্যের নির্দেশনায় কোনটি তাঁর জীবন যাপনের দৈনন্দিন প্রয়োজনের দাবি মেটানোর জন্য বাধ্য হয়ে তা হয়তো বাইরে থেকে সবটা উপলব্ধি করা যাবে না। অনেক কিছুই বিচার করতে হলে শেষ পর্যন্ত সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। কালের অনেক কালো চিহ্ন যে কোনো সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনেই লেগে থাকে কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে সত্য ও সুন্দর! সৈয়দ শামসুল হকের সাহিত্যিক জীবন থেকেও এমনি সত্য ও সুন্দর কালাতিক্রমী হবে এমন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।