কাওয়ালি সংগীত পুরান ঢাকার একটি গৌরবময় ঐতিহ্য। মধ্যযুগে এই সংগীতের মাধ্যমে উত্তর-ভারতীয় সংগীতের এক মহাজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের মধ্যে খেয়ালের যে সাংগীতিক বিস্তার, এর সাথে কাওয়ালির সম্বন্ধ নিবিড়। এর সূচনা হয়েছিল তুর্কি চারণকবিদের মাধ্যমে। ভারতে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি, নিজামুদ্দিন আউলিয়া, উস্তাদ আমির খসরু, সেলিম চিশতি, বদরুদ্দীন রিয়াজ, শাহনেওয়াজ কাওয়ালি সংগীতের বিকাশ ঘটান। বর্তমান কালের নুসরাত ফতে আলি খান, আবিদা পারভীন, বাংলাদেশের রুনা লায়লার নামও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
১৯৪৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিল্লি ভ্রমণের এক অভিজ্ঞতায় বলেন, “খাজাবাবার দরগার পাশে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান হচ্ছে। যদিও বুঝতাম না ভালো করে, তবুও মনে হতো আরো শুনি। আমরা দরগাহ জিয়ারত করলাম, বাইরে এসে গানের আসরে বসলাম। অনেকক্ষণ গান শুনলাম, আমরা যাকে ‘কাওয়ালি’ বলি। কিছু কিছু টাকা আমরা সকলেই কাওয়ালকে দিলাম। ইচ্ছা হয় না উঠে আসি। তবুও আসতে হবে।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ৫৬)।
কাওয়ালি সংগীত সুফিদের প্রতিনিধিত্বে বিকশিত হলেও এটি মূলত সেকুলার সংগীত। অর্থাৎ এখানে সবধর্মের মানুষ যুক্ত হতে পারে। কারণ কাওয়ালির উদ্দেশ্যই হলো সুরের মাধ্যমে গভীর ভাবদর্শনে উদ্বুদ্ধ করা। এর বাণী বিশ্বমৈত্রী, সৌহার্দ্য ও আধ্যাত্মিক উন্নতির নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। মধ্যযুগে ভারতে মুসলিম শাসনেরকালে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও সেকুলার হওয়ার কারণে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে এই ধারাকে গ্রহণ করেছিল। এখনো যেমন ভারত-পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিদ্বেষের কালেও ভারতীয় সিনেমায় কাওয়ালি সংগীতের আধিপত্য সর্বজনস্বীকৃত। পাকিস্তানেই বরং কিছুদিন আগে একজন প্রসিদ্ধ কাওয়ালকে হত্যা করা হয়েছিল। কারা করেছিল? উগ্রপন্থীরা।
বাংলাদেশে কাওয়ালি সংগীতের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লক্ষ লক্ষ অনুরাগী রয়েছেন। খুবই দুঃখজনক যে আজ কাওয়ালি আসরের ওপর আঘাত হয়েছে, পক্ষান্তরে তা মূলত এদেশের সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিকর্মীদের ওপরই আঘাত। এ আঘাত শিল্পীসমাজকেই রুখতে হবে। আজ যাদের নামে অভিযোগ এসেছে, আসলে তারা কারা? তাদের চিনতেই হবে।