বেঁচে থাকতে কেমন যেতো সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন। তেমন কোনো আয়োজন দেখতাম না কোথাও। কলকাতার পত্রিকাগুলোর দিকেও চোখ বুলালাম, সেখানেও নাই কিছু। মাঝখানে এক গুজব উঠেছিল, তিনি মারা গেছেন। বাসায় সাংবাদিক ডেকে বলতে হয়েছে, আমি অসুস্থ কিন্তু বেঁচে আছি। এই হলো আমাদের জীবন্ত কিংবদন্তীদের প্রতি ভালোবাসা। তবে তিনি বেঁচে ছিলেন, শেষ বয়সেও পদ্মশ্রী না নিয়েও নিজের যে সারাজীবনের আদর্শ তার জানান দিচ্ছিলেন। দু তিন বছর আগে গানও গেয়েছেন। আজ তিনি সত্যি চলে গেলেন।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নিয়ে সবচেয়ে সুন্দর গল্পটা শুনেছিলাম, কবীর সুমনের কাছে। তিনি বলেছেন, এরকম শিশুর মতো মানুষকে তিনি নাকি কখনো আর দেখেন নি। চকলেট নিয়ে হাসতে হাসতে আসতেন স্টুডিওতে সবার আগে। তখন উনার বয়স হয়ে গিয়েছে, তবুও গানের প্রতি কি দারুণ আত্মনিবেদন। আর কবীর সুমনকে শোনাতেন অনেক গল্প। কবীর সুমন জানিয়েছেন, সংগীত নিয়ে এমন আলাপ তিনি বড় বড় পণ্ডিতদের কাছেও কখনো শোনেন নাই। এটাই আসলে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এই গানের প্রতি নিবেদন, ভালো গান গাওয়া এটা উনার সারাজীবনের সাধনার ফল। উনার দাদাও গান শিখতেন, উনাকে গানের প্রতি অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। গান শেখাকে উনি রীতিমত নিজের আবশ্যিক কর্তব্য ভাবতেন। যখন তিনি ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সময়ে তখনও তিনি বড়ে গোলাম আলী খান আর তার ছেলের কাছে গান শিখে যাচ্ছেন। সব বড় বড় মানুষ ছিলেন তার ওস্তাদ, পণ্ডিত সন্তোষ কুমার বসু, অধ্যাপক এ টি ক্যানন এবং অধ্যাপক চিন্ময় লাহিরীর। কিন্তু তার জীবনে ভীষণ প্রভাব রেখেছেন ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান সাহেব। তাঁকে তিনি 'বাবা' বলে ডাকতেন। উনাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন বড়ে গোলাম আলী খান। শিক্ষার দেয়ার শুরুতেই বলে ছিলেন, 'সংগীত শিক্ষার বারো আনাই হলো শোনার ব্যাপার, কান কেমন তৈরি হলো তা। আর বাকী চার আনা ঘষে মেজে শিক্ষা দেয়া যায়।' উনি আর মীরা বন্দ্যোপাধ্যায় শিখতেন তাঁর কাছে। গলার যখন সাধতেন তখনই তাঁরা পাশের ঘরে বসে ওস্তাদকে অনুকরণ করতেন। বড়ে গোলাম আলী সাহেব হাসতে হাসতে নাকি বলতেন, 'এই দুই বিড়াল আমার গান শোনার আগেই গাওয়া শুরু করে, এদের পেশেন্স এত কম।'
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়-হেমন্ত জুটি বাংলা গানের সবচেয়ে সুন্দর সময়। গীতা দত্তের সাথে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা জুটি ছিল। কিন্তু গুরু দত্ত চলে যাওয়ার পর, গীতা দত্ত এত পরিমাণে পানাসক্ত ছিলেন যে তাঁকে সামলানো কঠিন ছিল। সন্ধ্যা সেই তুলনায় অনেক পরিণত। সমানে গেয়ে গেছেন সেই সময় প্লেব্যাক গান। তাঁকে হিন্দি ছবির প্রযোজকেরাও খুব পছন্দ করতেন। কিন্তু কি মনে করে তিনি সব ছেড়েছুড়ে তিনি বাংলা গানেই থাকলেন। সুচিত্রার লিপে তাঁর গান মনে হবে স্বর্গীয়। এছাড়া তিনি আধুনিক বাংলা গানের অসাধারণ একজন মেলোডি প্রধান শিল্পী। আজকেও তাঁর গান প্রাসঙ্গিক। আমি তার ছলনায়, চন্দন পালঙ্কে শুয়ে, মধুমালতী ডাকে আয়, কিছুক্ষণ আরো না হয় রহিতে, কে তুমি আমাকে ডাকো, হয়তো কিছুই নাহি পাবো, এ শুধু গানের দিন। কত ভালো ভালো গানের যে উনি শিল্পী তা গুনে শেষ করা যাবেনা। ১৯৭১ সালেও তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন। চাঁদা তুলেছেন, চ্যারিটি শো করেছেন, রেডিওতে আমাদের গান গেয়েছেন। ১৯৭২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারিতে তিনি একমাত্র বিদেশী শিল্পী, যিনি পল্টন ময়দানে জনসভায় গান গেয়েছেন।
এবার বলি অন্য একটা গল্প, খুলনায় আমাদের স্কুল টিচার ছিলেন সন্ধ্যা নামের একজন খ্রিষ্ট ধর্ম অনুসারী ম্যাডাম। উনি ক্লাসে মাঝেমধ্যে গান গাইতেন, প্রথম শুনিয়েছিলেন আমাদের, মধু মালতী ডাকে আয়। ভদ্রমহিলা কবছর আগে মারা গিয়েছেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান শুনলে আমার মনে হয় ম্যাডাম বেচেই আছেন, ক্লাস ফাইভের সমাজ ক্লাসে আমাকে বলছেন, 'জাকারিয়া পড়া বলতে পারো না, বন্ধুদের সাথে এত কিসের কথা? আমাকে শোনাও তো তোমার কথা। তোমার আলাপ শুনি'। ম্যাম, আসলেই আমাদের এখন আর তেমন কথা বেঁচে নাই। এক বিচ্ছিন্ন হয়ে সবার বেঁচে থাকা। ঐ ভুবনে ভালো থাকুন সন্ধ্যা ম্যাডাম ও গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।