• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫

সমকালীন ও চিরকালের আইয়ুব বাচ্চু


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: আগস্ট ১৭, ২০২২, ০৮:১২ এএম
সমকালীন ও চিরকালের আইয়ুব বাচ্চু

বাচ্চু ভাই চলে যাওয়ার তিন-চার বছর হয়ে গেল, আমাদের জীবন থেকে তিন বছরও ফুরিয়ে গেল। এ বছরে বছরে আমরা কী করেছি? কোনো একটা স্মারকগ্রন্থ বের করতে পারে নাই। কিছু অতিরঞ্জিত গল্প ছাড়া আর কিছুই জানা গেল না তাঁকে নিয়ে। সাজ্জাদ হোসেইনের সাথে একটা বই লেখার কথা ছিল। বাচ্চু চলে যাওয়ার কারণে তা হয়নি। চিটাগাংয়ে খালি একটা রুপালি গিটার বসেছে। এছাড়া আর কী, চ্যানেল আই স্মৃতি নিয়ে ব্যবসা করেছে, তা-ও ভালো দেয়নি নাম, আইএফআইসি ব্যাংক বাচ্চু মেলা। নাম দিয়েছিল, স্মৃতির দহন। বাংলালিংক কিছু কাজ করছে, বিভিন্ন ব্যান্ড আর্টিস্টদের ছোট ইন্টারভিউ তাঁদের মারফত বানানো হয়েছে। এসব সামান্যই। আসলে আমাদেরই কাজ করতে হবে, বাচ্চুর গান শুনতে হবে, তাঁকে নিয়ে লিখতেও হবে সারা বছর।

বাচ্চু ভাই কারও থেকে গিটার শিখেন নাই। তার এক বার্মিজ গিটারের টিচার ছিল তার কাছে তিনি শিখেছেন, জীবন ও সময়। তিনি নিজে নিজেই শিখেছেন। ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে ওঠার সময় বাচ্চু ভাইকে গিটার কিনে দেওয়া হয় বাবা কর্তৃক। তার বাবা যে খুব একটা পছন্দ করতেন গানবাজনা, সে রকম না। কিন্তু বাবাদের একটা অদ্ভুত আবেগ থাকে। আইয়ুব বাচ্চুর সবকিছুই সেলফ লার্নিং। তিনি শুনে শুনে ও প্র্যাকটিস করে শিখেছেন। দিনে ৮-১০ ঘণ্টা তিনি গিটার নিয়ে পড়ে থাকতেন। জিমি হ্যান্ড্রিকস, কার্লোস সান্টানা, রিচি ব্ল্যাকমোর, জো স্যাটরিয়ানি এরাই তার ফেভারিট। আশির দশকের মিউজিক এস্থেটিকস ভর করেছিল বাচ্চুর ভেতরে। বাচ্চু খুব ভালো ডিসটর্শন বাজাতে পারতেন। সোলসের কেউ কেউ বলত, ওটা কেড়ে নিলে বাচ্চুর আর কিছু নাই। এলআরবি মূলত সেই চ্যালেঞ্জ থেকেই করা, বাচ্চুর মতো নতুন গান হবে, তার সঙ্গে মেলোডিও থাকবে।

এই গান ও গিটারের জন্য বাচ্চু ঘর ছেড়েছেন আবার ফিরেছেন। মায়ের মৃত্যুর পর গান গাইবেন কি না তা নিয়ে সংশয়ে পড়েছেন, আবার গানেই ফিরেছেন। সংগীত তার কাছে প্রার্থনা। তিনি গিটার তেমন কাউকে শেখান নাই, কিন্তু সেই দু-একজনের ভেতরে আছে এখন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা সংগীত পরিচালক ও শিল্পী পার্থ বড়ুয়া। পার্থ বড়ুয়া সব সময় স্মরণ করেন ও বলেন আইয়ুব বাচ্চুর অবদান।

উনি চলে যাওয়ার পর অনেক অনেক ভালো কথা দেখতাম বিভিন্ন অনলাইন নিউজে। সামান্য সমালোচনাও নাই। বাচ্চুর যেমন একটা খারাপ প্রজেক্টের নাম বলি, উনি আবদুল আলীমের কাভার করেছিলেন এক অ্যালবামে। পুরাই ফালতু হয়েছিল। ইন্ডাস্ট্রির জন্য তিনি কিছু ফালতু গানও গেয়েছেন। সিনেমার গান গেয়ে পপুলারিটি পেয়ে তিনি একটা স্যুডো লোকরঞ্জনবাদে চলে গিয়েছিলেন। এই সব কথা কোথাও দেখি না। যেখানে জেমস অনেক এগিয়ে, তিনি ভালো লিরিসিস্ট পেয়েছেন কম। তবু বাচ্চু বাচ্চুই। আমাদের লিজেন্ড। কিছু অজনপ্রিয় গান তাঁর অসম্ভব ভালো। যেমন ধরুন নীলবেদনা, গতকাল রাতে, নীরবে—এসব শুনলে এখনো শরীরে একটা মেটাল জোশ আসে।

এলআরবি আনপ্লাগড অ্যালবামটা আলোড়ন তোলেনি মনে এমন কিশোরদের সংখ্যাও কম। তার সময়ে শো জমাতে পারত তারচেয়ে ভালো এমন শিল্পীও কম এদেশে। তাঁর বিলো অ্যাভারেজ কনসার্টও অসাধারণ। কিছু গান আছে জীবনমুখী গান, পেনশন, হকার, অনিমেষ, সাবিত্রী রায়, মাধবী। এইসব গান খুব যে বেশি লোক শুনেছে তা-ও না। বাচ্চুর কাছ থেকে আমরা আরেকটা জিনিস শিখতে পারি, সেটা হলো কথা বলা ও নতুন কিছু করার সাহস। ৯২ সালে কে ভেবেছিল ডাবল অ্যালবাম করতে, গান এত বেশি হয়ে গিয়েছিল এছাড়া কী করবে। সারগামও সাহসটা দেখিয়েছিল। বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকের জন্য সারগামের যে অবদান তা কে মনে রাখে? সে আমলের ক্যাসেটের কাভার দেখেন, এত ইউনিক আইডিয়া, দেখে তাক লাগা ছাড়া আর কী উপায় ছিল। সেই নিয়াজ রহমান অংশুকে কে মনে রেখেছে? এলআরবির ডাবল অ্যালবামে ব্যান্ডের ছবি তুলে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক ফটোগ্রাফার মনজুরুল আলম বেগ, এ খবর কয়জন জানে?

মৃত্যুর কয়েক মাস আগেও তিনি খালি গিটার নিয়ে চার ঘণ্টার শো করতেন। গান হবে না, শুধুই গিটার। এ রকম স্পর্ধা বাংলাদেশে কয়টা লোকের আছে? অনেক দিন আগে একবার টিভিতে ঈদের অনুষ্ঠান নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বিশেষ আয়োজনে যদি আপনার হিন্দি গান দেখাতে হয় তবে লোকজনের হাতে আরো ভালো হিন্দি গান শোনার মাধ্যম আছে।’ অনেক দিন আগে একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি মূলত এখন এমেচারদের জায়গা, বাপের কিছু টাকা আছে তারা পোস্টার ছাপায়, সিডি বের করে টাকা দিয়ে। তাদের গান তার বন্ধুরাই শোনে না, যে গান আপনার প্রিয় মানুষরাই পয়সা দিয়ে শোনে না, তাহলে আপনি কেমন শিল্পী।’ আরেক কথাটা তিনি বলে গেছেন যুদ্ধপরাধীদের বিচার নিয়ে, ‘বিচারের দাবি জানাতে রাজনীতি পক্ষ বিপক্ষে থাকতে হয় না।’

আমি বলব, ওনার চলে যাওয়াটা দুঃখের হলেও খুব বেশি বেদনার না। কারণ, তিনি দেখে ফেলেছেন এই রাষ্ট্রের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির নির্মাণ ও ধ্বংস। এত বেশি দুঃসংবাদ এই দেশে ঘটছেই, তাঁর মতো নরম মনের মানুষের জন্য তা বেশি আঘাতের মতোই। শিল্পী জুয়েল ভাইয়ের একটা গল্প আছে, ‘দেখা হলেই উনি বলত চল কিছু করি। অনেককেই হয়তো বলতো, কিন্তু করা হতো না আর, কিন্তু তিনি করতে চাইতেন।’ কত শিল্পীর কপাল খুলে দিয়েছেন উনি। এত বড় স্টার হয়েও ছিলেন অকপট, বন্ধুদের সাথে দেখা হলেই তিনি তিন চারটে গালি দিতেন ও খেতেন। যার সাথে তিনি একবার দেখা করে কথা বলেছেন, ভোলেননি আজীবন। আমার এক বন্ধু গিয়েছিল বাচ্চুর কাছে অন্য কাজে। তারপর সে বিয়াশাদি করছে, ভুড়ি বাগিয়েছে, বাচ্চু ভাইকে এক অনুষ্ঠানে দেখা হলো, সে জিগ্যেস করল ভাই আমাকে চেনেন। তিনি বললেন এই ব্রেন একটা বিশাল সুপার কম্পিউটার, তুই আসছিলি আমার কাছে অমুক কাজে? তোর মা ভালো আছে? এই জন্যই আমরা বাচ্চু ভাইকে মনে রাখব। তাঁর গান যেমন অসাধারণ, তিনিও একজন দারুণ মানুষ। জন্মদিনে শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা।

বাচ্চু চলে গেছেন। স্যুডো আশেকানদের লাইক কামানোর ব্যবস্থা দিয়ে গেছে! বিশেষ দিন আসলেই তারা বাচ্চুর কাছের লোক। বিশাল বিশাল পোস্ট। বাচ্চু আমাদের কাছে প্রাত্যহিক। সব দিনই তার গান শুনি। জেমস, বাচ্চু, হাসান, মাকসুদ এদের অস্বীকার করা মানে নিজের শৈশবকে অস্বীকার করা। কিন্তু আমাদের বেইল নাই, কারণ আমরা বাচ্চুর সাথে বিরিয়ানি নেহারি খাইনি, আপন শালা মরার সময় আইয়ুব বাচ্চু কল দিয়ে ধন্য করে নাই। এবং আমরা বাচ্চুর বিভিন্ন সস্তা গান, কিছু সিনেমার গান ও আবদুল আলীমের গানের রিমেকের ব্যাপারে ক্রিটিক্যাল বলে।

Link copied!