• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জেমস ওয়েব দুরবিনে তোলা ছবি সম্পর্কে যা জানা গেল


দীপেন ভট্টাচার্য
প্রকাশিত: জুলাই ১৩, ২০২২, ১০:২২ এএম
জেমস ওয়েব দুরবিনে তোলা ছবি সম্পর্কে যা জানা গেল

বিজ্ঞানীরা অনেক সময় সাধারণ মানুষের বিচক্ষণতায় বিশ্বাস রাখেন না, সেটির একটি উদাহরণ হলো জেমস ওয়েব দুরবিনে তোলা মহাকাশের একটি ক্ষুদ্র অংশের ছবি। ছবিটি চমৎকার, এই বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু তারা আমাদের একবারও মনে করিয়ে দিলেন না যে হাবল দুরবিন দিয়ে এ রকম ছবি এর আগেও আমরা দেখেছি। নিঃসন্দেহে হাবলের স্পষ্টতা ওয়েবের থেকে কম এবং সেটি তুলতে হাবলের অনেক সময় লেগেছিল, কিন্তু সেটির বৈজ্ঞানিক অবদান এখনো অনন্য।

জেমস ওয়েবের জ্যোতির্বিদরা তড়িঘড়ি করে একটি ছবি ছাড়লেন, কিন্তু স্পষ্ট করে বললেন না আমরা আসলে কী দেখছি। এমন যেন এটি একটি মণি মাণিক্যের ছবি, হিরে জহরত দেখে মুগ্ধ হও, এর বেশি তোমাকে বলে লাভ নেই, তুমি বোধহয় বুঝবে না। আসলেই আমরা বুঝছি না—

(১) ছবিটিতে উজ্জ্বল তারাগুলো, যেগুলো থেকে আটটি ছটা বের হচ্ছে, সেগুলোকে অগ্রাহ্য করুন, সেগুলো আমাদের গ্যালাক্সির তারা—not interesting.

(২) ছবিটির কেন্দ্রের দিকে দেখবেন কিছু সাদা গ্যালাক্সি জটলা পাকাচ্ছে। এটাকে বলা হচ্ছে SMACS 0723 গ্যালাক্সিদল (cluster)। এটি একটি অখ্যাত গ্যালাক্সিদল। এটি সম্বন্ধে আমাদের কিছুই বলা হয়নি। শুধু জানি এখান থেকে আলো আসতে ৪৬০ কোটি বছর লাগছে।

(৩) ভালো কথা, তাহলে আবার কেন বলছ এই ছবিতে বহু পুরোনো গ্যালাক্সিও (১৩০০ কোটি বছর আগে সৃষ্ট) দেখা যাচ্ছে। কোথায় সেগুলো? কেন সেগুলো হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলে না?

(৪) যা বুঝতে পারছি কোন গ্যালাক্সিগুলো আরও দূরে সেগুলোকে নিয়ে ওয়েবের জ্যোতির্বিদরা জল্পনা করছেন, তারা মনে হয় ঠিক নিশ্চিত নন। তাহলে আমরাই কিছু জল্পনা করি ...

(৫) খেয়াল করে দেখুন কেন্দ্রের চারদিকে একটি বৃত্তের পরিধিতে কয়েকটি সরু বক্রাকার গ্যালাক্সি দেখা যাচ্ছে। মহাকর্ষীয় লেন্সিংয়ের (gravitational lensing) ফলে একটি পেছনের গ্যালাক্সির আলো তার সামনে কোনো বড় ভর থাকলে সেটির দেশকালের বক্রতা অনুসরণ করে ভরটির সামনে (তার চারদিকে) কয়েকটি বিম্বে বিভক্ত হয়ে যায়। এ রকম লেন্সিংয়ের বহু উদাহরণ আছে। মনে হচ্ছে এ রকম অন্তত একটি গ্যালাক্সিকে আমরা দেখছি। NASA কিন্তু lensing নিয়ে কিছুই বলছে না। কিন্তু তারা কি এই lensed গ্যালাক্সির আলোর বয়স ১৩০০ কোটি বলছে? মনে হয় না, কারণ lensed গ্যালাক্সিটি SMACS cluster থেকে খুব পেছনে মনে হয় না।

(৬) খেয়াল করুন, চিত্রে আরও বক্রাকার গ্যালাক্সি আছে। সেগুলোও কি lensed? মনে হয় না, কিন্তু এর মধ্যে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। মনে হচ্ছে ক্যামেরার lens distortion-এ অনেক গ্যালাক্সিই কেন্দ্রের চারদিকে একটা বক্রাকার পথে সজ্জিত।  

(৭) ওপরের কথনটিকে সিরিয়াসলি নিতে বলছি না, কিন্তু তুলনা হিসেবে Hubble Deep Field-এর একটি ছবি দেখাচ্ছি। এ রকম distortion প্রথম দৃষ্টিতে সেখানে স্পষ্ট নয়।

(৮) তাহলে কোন গ্যালাক্সিটা সবচেয়ে দূরে? এখানে আমাদের অনুমান করতে হবে। বাছতে হবে একটি ম্লান লাল গ্যালাক্সি। আমি একটা বাছলাম, আপনিও বাছুন।  

(৯) এই ছবিটি আকাশের কতটা অংশ জুড়ে আছে? ওনারা বললেন, একটি বালুকণাকে এক হাত দূরত্বে রাখলে সেটি আমাদের চোখে যে আকার সৃষ্টি করবে, আকাশে এই ছবিটির আকার ততটুকুই। এ কী অদ্ভূত উপমা? এর থেকে কিছুই বোঝা গেল না। একটি বালুকণার আকার কতটুকু? কে জানে সেটা? কেউ না!! সেটা 0.05 থেকে 2 মিলিমিটার হতে পারে। আর এক হাত দূরত্বটাই বা কত? তাও সঠিক কারুর জানা নেই। আমি যদি এক হাত দূরত্ব 0.5 মিটার ধরি, তবে সেই বালুকণা আমার চোখে 0.005 থেকে 0.2 ডিগ্রি কোণ প্রক্ষেপণ করবে। পূর্ণ চাঁদ হল 0.5 ডিগ্রি। ওনারা কি বলতে পারতেন না এই ছবিটি চাঁদের 0.2/0.5 = 40% অংশ বা 0.005/0.5 = 1%? 1% আর 40% এর মধ্যে তো বিশাল পার্থক্য, তাহলে এরকম অর্থহীন উপমা দেবার দরকার কী? এতে বিজ্ঞানের কোনো লাভ হয় না।

(১০) বিজ্ঞানকে সাধারণের কাছে গুরুত্বসহকারে উপস্থাপন করা দরকার। অনেক বিজ্ঞানীই সাধারণের বোধ-ক্ষমতার ওপরে আস্থা রাখেন না। এটা হল একটা, কিন্তু তারা এই ছবিটার যে সঠিক অর্থ আমাদের দিতে পেরেছেন তেমনও নয়।

(১১) এই সব সমালোচনার উদ্দেশ্য জেমস ওয়েবকে খাটো করার জন্য নয়, এটি মানুষের কৌতূহল, মেধা ও সৃষ্টিশীলতার এক অত্যাশ্চর্য মেলবন্ধন। সেই দুরবিন যা পাবে তা আমাদের সবার সম্পদ। আমরা সেই সম্পদকে গুরুত্ব দিই বলে এত কথা।

Link copied!