• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১১ শাওয়াল ১৪৪৫

আততায়ীর গুলি ছিনিয়ে নিল আবে স্যারকে!


প্রবীর বিকাশ সরকার
প্রকাশিত: জুলাই ৮, ২০২২, ০৭:০১ পিএম
আততায়ীর গুলি ছিনিয়ে নিল আবে স্যারকে!

মানুষের জীবনে কখন কার সঙ্গে কার সাক্ষাৎ ঘটবে আগে থেকে বলা অসম্ভব। স্বপ্ন দেখা বা পরিকল্পনা করেও ঈপ্সিত মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা হয়ে ওঠে না জীবদ্দশায়। আসলে মানুষের অজানা নিয়তি তাকে সেদিকেই নিয়ে যায়। এটাকেই আমরা বলি অদৃষ্ট। এভাবে অদৃষ্টের কারণেই আমার জীবনে অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তির হাতের স্পর্শ লাভ করেছি। যাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে বা কথা হবে স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি। তার প্রধান কারণই হচ্ছে সামাজিক অবস্থান। আমার যে সামাজিক অবস্থান একজন সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ হিসেবে সেই অবস্থানে থেকে আমার চেয়ে বহুগুণ ঊর্ধ্বে আসীন কোনো উচ্চপদস্থ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াটা বামুনের চাঁদ ধরার মতোই অলৌকিক ঘটনা বটে!

জাপানে দীর্ঘদিন বসবাসের ফলে দেশ-বিদেশে খ্যাত অনেক ব্যক্তির সঙ্গেই অপ্রত্যাশিতভাবে সাক্ষাৎ হয়েছে। তাঁদের মধ্যে জাপানের বর্তমান প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আবে শিনজোও অন্যতম প্রধান। ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়ে যায় অপ্রত্যাশিতভাবেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দীর্ঘকালীন প্রধান মন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন একাধিবার নির্বাচিত হয়ে, এই তালিকায় তিনি চতুর্থ। অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা তিনি পেয়েছিলেন বিগত দুই দশকের বেশি সময়ে। 


এহেন প্রধানমন্ত্রী আবে শিনজোওর উত্থান ঘটেছে জাপানের কতিপয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারের দুটি পরিবার থেকে এবং পিতৃ-মাতৃকুল উভয়েরই উত্তরাধিকারী তিনি। আবের পিতা এবং পিতামহ হচ্ছেন যথাক্রমে জাপানের প্রাক্তন প্রভাবশালী পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবে শিনতারোও এবং পিতামহ আবে কান ১৯৩৭-৪৬ পর্যন্ত ডায়েট তথা সংসদের প্রতিনিধিসভার সদস্য ছিলেন। তাঁরই পুত্র আবে শিনতারোও ছিলেন কট্টর ন্যাশনালিস্ট, এলডিপির অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী।

জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সঙ্গে লেখক

অন্যদিকে, আবে শিনজোওর মাতামহ কিশি নোবসুকে আরও বেশি প্রভাবশালী এবং ন্যাশনালিস্ট ছিলেন। কিশির ছোটভাই সাতোও এইসাকু জাপানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং ১৯৭৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। কিশি ১৯২০ সালে জাপান সরকারের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ করেন টোকিও ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেয়ার পর। যুদ্ধ চলাকালীন প্রধানমন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকির মন্ত্রীসভার মন্ত্রী ছিলেন। তথাকথিত ‘এ’ শ্রেণীভুক্ত যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারাধীন ছিলেন কিন্তু রহস্যজনকভাবে মুক্তি পান। ১৯৪২ সালেই তিনি সংসদের নিম্নসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে জাপান সোস্যালিস্ট পার্টিতে যোগদান করলেও ছোটভাইয়ের পরামর্শে পরবর্তীকালে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। এই পার্টিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুজন প্রধানমন্ত্রী যথাক্রমে য়োশিদা শিগেরু এবং হাতোয়ামা ইচিরোও। এই হাতোয়ামা ইচিরোওর পর পরবর্তীকালে দুদুবার প্রধানমন্ত্রী হতে সক্ষম হন কিশি নোবুসুকে। তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশে জন্ম এবং ভারতে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত একজন বাঙালির সঙ্গে সুগভীর হার্দিক বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। তিনি বিচারপতি ড. রাধাবিনোদ পাল, টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের অন্যতম বিচারপতি ছিলেন এবং মিত্রশক্তি কর্তৃক যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত ২৮ জনকে নির্দোষ বলে রায় দিয়ে বিশ্ব ইতিহাস সৃষ্টি করেন। বিচারপতি পালের সুবিশাল রায়টি জাপানি ভাষায় প্রকাশিত হয় প্রধান মন্ত্রী কিশির বদৌলতেই। যে কারণে কিশির দৌহিত্র আবে শিনজোও বিচারপতি পালের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। ২০০৭ সালে তিনি কলকাতায় পালের পুত্র আইনজীবী প্রশান্ত কুমার পালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

আবে শিনজোও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জাপানের অর্থনীতিতে এক নতুন গতি এনেছেন যাকে বলে ‘আবেনোমিক্স’। ২০১৪ সালের মে মাসে প্রধান মন্ত্রী আবের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফর করেন। দুদেশের মধ্যে অর্থ-বাণিজ্য এবং উন্নয়নমূলক চুক্তি সম্পন্ন হয়। আবে ৬ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সফর করবেন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, এশিয়ার আঞ্চলিক শান্তির বিষয়েও তিনি সোচ্চার। উত্তর কোরিয়ার গুপ্তদালাল কর্তৃক অপহরণকৃত জাপানি নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার জন্যও তিনি দীর্ঘ বছর ধরে অক্লান্ত লড়াই করেছেন। কট্টর জাতীয়তাবাদী হলেও তিনি মনেপ্রাণে আন্তর্জাতিকমনস্ক রাজনীতিবিদ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে গঠিত ‘আশিয়ান’ গোষ্ঠীতে তাঁর রয়েছে ব্যাপক প্রভাব এবং তাঁর প্রতি রয়েছে নেতৃবৃন্দের গভীর আস্থা। অন্যদিকে, ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও আবের গভীর বন্ধুত্ব রয়েছে বলে জানা যায়। সাম্প্রতিককালে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক জোট তথা “Quad” গঠিত হয়েছে চারটি দেশ যথাক্রমে জাপান-অস্ট্রেলিয়া-ইন্ডিয়া-ইউএস মিলে। নয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চিনের আধিপত্যবাদকে ঠেকাতে এই জোটের মূল পরিকল্পনা আবে শিনজোরওরই।

আবে শিনজোও আমার খুব প্রিয় ব্যক্তিত্ব এবং রাজনীতিবিদ ছিলেন। তাঁর একটি অসাধারণ মন্তব্য দিয়ে আমার রচিত জাপানি ভাষার গ্রন্থের  “নিহোন গা আজিয়া অ মেজামে সাসেতা” (জাপান এশিয়াকে জাগ্রত করেছে) সূচনা করেছিলাম। আজ তিনি স্মৃতি হয়ে গেলেন! গভীর গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করছি তাঁর পবিত্র আত্মার প্রতি। তাঁর তিরোধানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার এক অকৃত্রিম বন্ধুকে হারাল।
একই সঙ্গে “জাপান -বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবে”র পক্ষ থেকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা।

 

লেখক : জাপান প্রবাসী বাংলাদেশি প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Link copied!