• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয় সংসদে সাম্প্রদায়িক উসকানি উদ্দেশ্যমূলক


মোজাফ্‌ফর হোসেন
প্রকাশিত: জুলাই ৪, ২০২২, ০৩:৫৪ পিএম
জাতীয় সংসদে সাম্প্রদায়িক উসকানি উদ্দেশ্যমূলক

জাতীয় সংসদে সাম্প্রদায়িক মুসলমানদের উসকে দিয়েছেন জাতীয় পার্টির এমপি ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফখরুল ইমাম। তিনি যা বলেছেন, তার সারমর্ম হলো : স্কুলের পাঠ্যসূচিতে ইসলাম ধর্মের সব কিছু বাদ দিয়ে হিন্দুধর্ম শেখানো হচ্ছে। কোরানবিরোধী কবিতা (বই শীর্ষক) পড়ানো হচ্ছে। মুসলমান বাদ দিয়ে হিন্দুধর্মীয় সংস্কৃতির পাঠ দেওয়া হচ্ছে।

এইটা একদল মুসলমান নিজেদের বোধবুদ্ধি দিয়ে বিচার না করে সঙ্গে সঙ্গে পিক করেছে। আমাকে অচেনা কয়েকজন ইনবক্সে পাঠিয়ে আমার মতামত চেয়েছেন। আমি তাদের একজনকে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছি :  বাংলাদেশের পাঠ্যসূচিতে হিন্দুধর্ম প্রাধান্য? আপনি পাগল নাকি? এইসব লোকের কথা না শুনে গত দশ বছরের পরিবর্তিত সিলেবাস ঘেটে দেখেন, উল্টোটা হয়েছে। আমরা তা নিয়ে আন্দোলন করেছি, সেসব আপনার চোখে কেন পড়েনি সেটাও প্রশ্ন বটে। তবে আমি এও মনে করি, ভারতে স্কুলে বাচ্চাদের বেশি করে ইসলাম নিয়ে পড়ানো উচিত আর বাংলাদেশের স্কুলে হিন্দুধর্ম। নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে আমাদের স্কুলে গিয়ে জানা লাগে না।

বাড়িতে-মসজিদে-খুতবায়-ওয়াজে-আড্ডায় আমরা সব জেনে যাই। নামাজে দাঁড়িয়েই আমাদের গোটা ত্রিশেক সুরা মুখস্ত হয়ে যায়। কিন্তু হিন্দুধর্ম সম্পর্কে জানার সুযোগ থাকে না। মুখে মুখে যা জানি, সেটা আরো বিভ্রান্তিকর। অনুরূপভাবে, ভারতে ইসলাম সম্পর্কে জানার সুযোগ থাকে না। সেখানেও মুসলমানদের ভুলভাবে জানা হয়। হিন্দুধর্ম মানেই গরুর হিসু খাওয়া—এদেশের অধিকাংশ মুসলমানদের জ্ঞান এই পর্যন্তই দাঁড়ায়। আর ইসলাম মানেই বোমাবাজি—ভারতের হিন্দু পরিবারের শিশুরা মুসলমান বলতে সেটাই শিখছে। না-জানার চেয়ে সাংঘাতিক হলো পরস্পর পরস্পরকে বিকৃতভাবে জানা। সেটাই হয়ে আসছে। যদি সত্যিকার অর্থেই আমরা এই ধর্মীয় উন্মাদনা খুনোখুনি থেকে বের হতে চাই তাহলে পরস্পরকে জানার কোনো বিকল্প নেই। জানার মধ্য দিয়ে সহিষ্ণুতা তৈরি হবে।

কাজটা স্কুল থেকে শুরু হতে পারে। স্কুল দেবে জ্ঞান, জ্ঞান মানে যেটা আমরা কম জানি। তাই ভারত এবং বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে পৃথক পৃথক ধর্ম বই না থেকে, একটা সমন্বিত ধর্মের বই থাকবে, স্কুলের সব ধর্মের বাচ্চা একই বই পড়বে। শিশুরা নিজেদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম বলে আলাদা হয়ে যাবে না। শিক্ষকও হবেন এমন, যিনি সব ধর্ম পড়াতে পারবেন। এখানে ধর্মকে পড়ানো হবে জ্ঞান হিসেবে। সমন্বিত নৈতিক শিক্ষা পাবে শিশুরা।

এই কথাগুলো যখন লিখছি তখনও জানতাম না জনাব ফখরুল ইমাম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সংসদে উল্টাপাল্টা বলছেন। আমি শুধু জানতাম, উনি যেটা বলছেন সেটা এই বাংলাদেশে কোনোভাবেই সম্ভব না। বরঞ্চ উল্টোটা ঘটছে বলে নানা প্রমাণ আমরা পেয়েছি সিলেবাস পরিবর্তনের বিভিন্ন ধাপে। শেষ পর্যন্ত চাপের মুখে সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তিনি ২০১৬ সালে দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট হুবহু সংসদে পড়েছেন। প্রথমত তিনি রিপোর্টের সালটা দেখেননি। দ্বিতীয়ত তিনি ইনকিলাবের ভুয়া রিপোর্ট সত্য বলে মেনে নিয়েছেন। এতে প্রমাণিত হয় তিনি ইনকিলাব ছাড়া আর কোনো দৈনিক তেমন পড়েন না। অথবা তিনি বুঝেই আকামটা করেছেন। জেনে বুঝেই করেছেন মনে করছি, কারণ বাংলাদেশ সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা থাকলে কেউ এই কথা বলতে পারে না। এখন প্রশ্ন হলো, জাতীয় সংসদে কেন তিনি দেশকে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার মধ্যে ঠেলে দেবেন? কেন তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করবেন? জাতীয় সংসদে সেটা কেউ করতে পারে কিনা?

কদিন আগেই আরেক সংসদ সদস্য ফিরোজ রশিদ সংসদে নারীবিদ্বেষী মন্তব্য করলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাফপ্যান্ট পরা ছাড়া মেয়ে দেখতে পান না। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হাতে হাতে নাকি চা ও সিগারেট থাকে। এতে সমাজ নষ্ট হয়ে গেল। বিপরীতে মাদরাসায় মেয়েরা তাহাজ্জতের নামাজ পড়ে সমাজ রক্ষা করছে। জানি না জনাব ফিরোজ রশিদের কটা ছেলেমেয়ে মাদরাসায় পড়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি নারী স্বাধীনতার বিরোধী হতে পারেন, কিন্তু জাতীয় সংসদে কিভাবে সেটা চর্চা করতে পারেন? জাতীয় সংসদে এইসব আপত্তিকর এবং অপ্রাসঙ্গিক কথা বলবেন কেন?

এখন তিনিও হয়তো তার কথা তুলে নেবেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো : যারা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উসকে দেবেন, তেঁতুল হুজুরদের উসকে দেবেন, তাদের কোনো শাস্তি থাকবে না? প্রত্যাহার বললেই হলো?

Link copied!