• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫

উড়ন্ত সেলফোন টাওয়ার


ইশতিয়াক হোসেন
প্রকাশিত: নভেম্বর ১, ২০২১, ০৩:২৯ পিএম
উড়ন্ত সেলফোন টাওয়ার

গ্রাম থেকে শহরাঞ্চল, কৃষিক্ষেত থেকে সমুদ্রসৈকতে নিমেষেই যোগাযোগ হয় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। মোবাইল সেবা নিশ্চিতে দেশজুড়ে দৃশ্যমান থাকে সেলুলার টাওয়ার। এই টাওয়ার স্থাপন করে মোবাইল সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। 

সেলুলার টাওয়ারে মোবাইল সংযোগ স্থাপনে নানা রকম যন্ত্রপাতি বসানো থাকে। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় মোবাইল টেলিফোন সেবা ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করে এই টাওয়ার। এভাবে বিভিন্ন এলাকায় মোবাইল সংযোগ স্থাপনের জন্য সেলুলার টাওয়ার স্থাপন করা হয়।

সারা দেশে প্রতিটি প্রান্তে মোবাইল সার্ভিস সহজলভ্য করতে সেলুলার টাওয়ারের প্রয়োজনীয়তা অনেক। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আগের চেয়ে আরও দ্রুত এবং অধিক পরিমাণ ডাটা বহুসংখ্যক ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে দিতে হচ্ছে। তাই ক্রমবর্ধমান ব্যবহারকারী ও এলাকায় মোবাইল টেলিফোন সংযোগ দেওয়ার জন্য আরও বেশি সেলুলার টাওয়ার স্থাপন করছে মোবাইল সেবা দানকারীরা। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে টেলিফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ, পরিষ্কার শব্দ, ইন্টারনেট ডাটা এমনকি সরাসরি ভিডিও তথ্য আদান-প্রদানের জন্য নির্দিষ্ট দূরত্বে সেলুলার টাওয়ার বসানো হয়।

প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে সেলুলার টাওয়ারগুলোও আরও আধুনিক ও শক্তিশালী হচ্ছে। এরপরও সেলুলার টাওয়ারের কিছু সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। যেমন হাসপাতাল, স্কুল, আবাসিক এলাকার ১০০ মিটারের মধ্যে সেলুলার টাওয়ার স্থাপনের উপর কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে।

অন্যদিকে পাহাড়-পর্বত, উঁচু দালান, গাছপালার জন্য সেলুলার টাওয়ার থেকে আদান প্রদান করা সংকেত বাধা পায়। আবার কিছু এলাকা সেলুলার টাওয়ারের আওতা থেকে দূরে থাকার ফলে মোবাইল যোগাযোগ ব্যাহত হয়। তবে বাহনের পেছনে স্থাপন করে সাময়িক সময়ের জন্য সেলুলার টাওয়ারের আওতাবহির্ভূত এলাকায় মোবাইল যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। কিন্তু যেসব এলাকায় রাস্তা নেই, সেখানে পরিবহনে করে এই পদ্ধতিতে মোবাইল সংযোগ স্থাপন সম্ভব নয়।

বর্তমানে তথ্য যোগাযোগ যেখানে শক্তি, সেখানে মোবাইল ফোন সংযোগের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সেলুলার টাওয়ারের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা থাকলেও যোগাযোগ বন্ধ রাখা যায় না। যেকোনো পদ্ধতিতেই সেলুলার মোবাইল সংযোগ স্থাপন জরুরি। সেই চিন্তা থেকেই মোবাইল টেলিফোন প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত সেলুলার সেবা পৌঁছানোর একটি পদ্ধতি বের করেছে, যার নাম 'COW'।

মনে হতে পারে, গৃহপালিত চতুষ্পদ প্রাণী গরুর সঙ্গে এর কি সম্পর্ক রয়েছে? না, কোনো সম্পর্ক নেই। 'COW' এর পূর্ন অর্থ "cell on wing" মানে ডানাযুক্ত সেল। অন্য কথায় বলা যায়, এই পদ্ধতিতে সেলফোন টাওয়ার বাতাসে ভাসমান বা উড়ন্ত অবস্থায় থাকে।

বড় এবং ভারী টাওয়ার ডানাযুক্ত করে উড়ানো অত্যন্ত কঠিন মনে হলেও 'COW' কিন্তু ছোট ড্রোন আকৃতির। ড্রোন সাধারণত যুদ্ধ ক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের দুর্গ ধ্বংস করার জন্য মারণাস্ত্র বহনকারী যান অথবা নজরদারির জন্য ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে ড্রোন অন্য কাজেও ব্যবহার হচ্ছে।যেমন-খেলনা, চিত্র ধারণ কিছু ক্ষেত্রে কৃষি কাজ ইত্যাদি।

ড্রোন এমন এক উড়ন্ত বাহন যার মধ্যে কোনও পাইলট থাকে না। দূর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একে উড়ানো হয়। যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে এই ড্রোন পাঠানো সম্ভব। তাই প্রত্যন্ত এলাকায় সেলুলার সংকেত প্রচারের সুবিধার্থে ড্রোনকে ব্যবহারের আগ্রহী হয়ে উঠেছে  তথ্য যোগাযোগ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

'cell on wing' এর জন্য বিভিন্ন প্রকার ড্রোন ব্যবহার করা হয়। ২০১৭ সালে মার্কিন টেলিকমুনিকেশন প্রতিষ্ঠান স্প্রিন্ট প্রথম 'COW' প্রযুক্তি ব্যবহার করে। তাদের প্রথম ড্রোনটি হেলিকপ্টারের মতো দেখতে ছিল। এতে ম্যাজিক বক্স নামে জুতার বাক্সের সমান ২.৫ গিগাহার্জের ৪জি ট্রান্সমিটার বসানো ছিল। এই 'COW' ড্রোন ২৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে নিকটবর্তী সেলুলার টাওয়ারের সঙ্গে সংযুক্ত করে।

বর্তমানে এটিএন্ডটিসহ বিশ্বের বেশকিছু টেলিকমুনিকেশন প্রতিষ্ঠান 'COW' প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। দুর্গম এলাকা যেখানে সেলুলার টাওয়ার স্থাপন হয়নি বা করা সম্ভব না, ঝড়-ঝঞ্ঝা, ভুমিকম্প, জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা অথবা হাওর বা সমুদ্রে, পাহাড়ি এলাকায় এই প্রযুক্তি সবচেয়ে কার্যকর। এছাড়াও কনসার্ট, মেলা চলাকালীন সিগন্যাল বৃদ্ধি করার জন্য অথবা সেলুলার টাওয়ার রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতে এই 'COW' ড্রোন ব্যবহার করা হয়। 

'COW' ড্রোন অন্য যেকোনো সেলুলার টাওয়ারের মতো টেলিকমুনিকেশন  সেবার পাশাপাশি ইন্টারনেট ডাটা আদান-প্রদান করতে পারে।

বর্তমানে টেলিকমুনিকেশন ড্রোনগুলো ৪ শত ফিট উচ্চতায় উড়ে। যা একটি স্বাভাবিক সেলুলার টাওয়ারের উচ্চতা থেকে প্রায় ৫০০ গুণ বেশি। ফেসবুক এবং গুগলের মতো প্রযুক্তি নির্ভর বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো একধাপ এগিয়ে বিশেষ ধরনের ড্রোন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করছে।

টেলিকমুনিকেশন ও ইন্টারনেট সেবা প্রদানে প্রতিষ্ঠানগুলোর ইচ্ছে, এমন একটি ড্রোন তৈরি করা যা স্যাটেলাইটের বিকল্প হিসেবে কাজ করবে।

২০১৯ সালে মার্কিন প্রতিষ্ঠান অল্টাডিভাইস সৌর শক্তিচালিত বিশেষ ড্রোনের পরীক্ষা চালায়। যা সর্বোচ্চ ৬০ হাজার ফিট উচ্চতায় উড়তে পারবে মাসের পর মাস। এই পরীক্ষা এখন চলমান থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি তাদের ড্রোন গোয়েন্দা নজরদারি এবং অনুসন্ধান, উদ্ধারকাজ, সীমান্ত টহল,  ভূচিত্র তৈরিসহ টেলিকমুনিকেশন ও ইন্টারনেট সেবার জন্য তৈরি করছে। 

প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত, দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায় সেলুলার সিগন্যাল বৃদ্ধিসহ টেলিকমুনিকেশন ও ইন্টারনেট সেবা প্রদানের জন্য 'COW' ড্রোন সেলফোন টাওয়ারের একটি চমৎকার বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায়।

এদিকে সেলফোন টাওয়ারের সুবিধা হচ্ছে, একটি টাওয়ার অনেকগুলো সেলফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করতে পারে। তবে ক্ষতিকারক প্রভাব বিবেচনায় বড়সড় দালান বা বাসা বাড়ীর ছাদে স্থাপিত সেলফোন টাওয়ার থেকে যে পরিমাণ ইলেকট্রনিক বিকিরণ তৈরি হয় তা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

বিশেষ করে আবাসিক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, স্কুল বা হাসপাতালের কাছে স্থাপিত সেলফোন টাওয়ার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরুপ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

Link copied!